‘সময়ের প্রয়োজনে‘ গল্পটি জহির রায়হানের মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক এক অনবদ্য রচনা। এই গল্পে একজন মুক্তিযোদ্ধার গল্প আছে, একজন? না না হাজারও মুক্তিযোদ্ধার প্রতিচ্ছবি যেন এ গল্প। চলুন সেই গল্পটাই শুনি।
সামনে ধানক্ষেত। বিরাট আকাশ। একটা লাউয়ের মাচা। দূরে আরেকটা গ্রাম। গ্রামের নাম রোহনপুর। ওখানে এসে ঘাঁটি পেতেছে ওরা, একদিন যারা আমাদের অংশ ছিল।
ডায়েরিতে আর কিছু লেখা নেই। যার ডায়েরী, দিন কয়েক আগে একটা অপারেশনে গিয়ে ওদের হাতে ধরা পড়েছে সে।
তারপর?
তারপরের খবর ঠিক বলতে পারছি না। হয়তো মেরে ফেলেছে। বেঁচেও থাকতে পারে হয়তো।
প্রথম প্রথম কাউকে মরতে দেখলে ব্যথা পেতাম। কেমন যেন একটু দুর্বল হয়ে পড়তাম। কখনো চোখের কোণে একফোঁটা অশ্রু হয়তো জন্ম নিত। এখন অনেকটা সহজ হয়ে গেছি। কী জানি, হয়তো অনুভূতিগুলো ভোঁতা হয়ে গেছে, তাই। মৃত্যুর খবর আসে। মরা মানুষ দেখি। মৃতদেহ কবরে নামাই। পরক্ষণে ভুলে যাই।
রাইফেলটা কাঁধে তুলে নিয়ে ছোট্ট টিলাটার ওপরে এসে দাঁড়াই।
সামনে তাকাই। বিরাট আকাশ। একটা লাউয়ের মাচা। কচি লাউ ঝুলছে। কয়েকটা ধানক্ষেত। দুটো তালগাছ।

দূরে আরেকটা গ্রাম। খবর এসেছে ওখানে ঘাঁটি পেতেছে ওরা। একদিন যারা আমাদের অংশ ছিল। একসঙ্গে থেকেছি। শুয়েছি। খেয়েছি। ঘুমিয়েছি। এক টেবিলে বসে গল্প করেছি। প্রয়োজন বোধে ঝগড়া করেছি। ভালোবেসেছি। আজ তাদের দেখলে শরীরের রক্ত গরম হয়ে যায়। চোখ জ্বালা করে ওঠে। হাত নিশপিশ করে। পাগলের মতো গুলি ছুড়ি। মারার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠি। একজনকে মারতে পারলে উল্লাসে ফেটে পড়ি। ঘৃণার থুতু ছিটাই মৃতদেহের মুখে।
সামনে ধানক্ষেত। একটা লাউয়ের মাচা। পেছনে কয়েকটা বাঁশবন। আড়ালে চার-পাঁচটা তাঁবু। একটা পুরনো দালান। ওখানে আমরা থাকি।
মোট সাতাশজন মানুষ।
প্রথম ঊনিশজন ছিলাম। আটজন মারা গেল মর্টারের গুলিতে। ওদের নামিয়ে দিয়ে যখন ক্যাম্পে ফিরলাম, তখন আমরা এগারোজন।
একজন পালিয়ে গেল সে-রাতে। গেল, আর এলো না। আর একজন মারা গেল হঠাৎ অসুখ করে। কী অসুখ বুঝে ওঠার আগেই হাত-পা টান টান করে শুয়ে পড়ল সে। আর উঠল না। তার বুকপকেটে একটা চিঠি পেয়েছিলাম। মায়ের কাছে লেখা। “মা। আমার জন্য তুমি একটুও চিন্তা কোরো না, মা। আমি ভালো আছি। “
চিঠিটা ওর কবরে দিয়ে দিয়েছি। থাকো। ওখানেই থাকো।
তখন ছিলাম ন’জন। এখন আবার বেড়ে সাতাশে পৌঁছেছি।
সাতাশজন মানুষ।
নানা বয়সের। ধর্মের। মতের।
আগে কারো সঙ্গে আলাপ ছিল না। পরিচয় ছিল না। চেহারাও দেখিনি কোনোদিন।
কেউ ছাত্র ছিল। কেউ দিন-মজুর। কৃষক। কিংবা মধ্যবিত্ত কেরানি। পাটের দালাল। অথবা পদ্মাপারের জেলে।
এখন সবাই সৈনিক।
একসঙ্গে থাকি। খাই। ঘুমোই।
রাইফেলগুলো কাঁধে তুলে নিয়ে যখন কোনো শত্রুর সন্ধানে বেরোই তখন মনে হয় পরস্পরকে যেন বহুদিন ধরে চিনি। জানি। অতি আপনজনের মতো অনুভব করি।
ওষুধ ফুরিয়ে গেছে। আনতে হবে। ক’দিন ধরে শুধু ডাল-ভাত চলছে। একটু মাছ আর মাংস পেলে মন্দ হতো না।
সাতাশজন মানুষ আমরা। মাত্র ন’টা রাইফেল। আরো যদি অস্ত্র পেতাম। সবার হাতে যদি একটা করে রাইফেল থাকত, তাহলে সেদিন ওদের একজন সৈন্যও পালিয়ে যেতে দিতাম না।
মোট দু শ জনের মতো এসেছিল ওরা। ৪৫টা লাশ পেছনে ফেলে পালিয়েছে। তাড়া করেছিলাম আমরা। খেয়াপার পর্যন্ত। গুলি ফুরিয়ে গিয়েছিল বলে ফিরে চলে এসেছি।
পেছনে কয়েকটা বাঁশবন। আড়ালে চার-পাঁচটা তাঁবু। একটা পুরনো দালান। সে দালানের গায়ে কাঠকয়লা দিয়ে অনেক ছোট ছোট রেখা এঁকেছি আমরা। ওগুলো মৃতের হিসাব।
আমাদের নয়।
ওদের।
যখনই কোনো শত্রুকে বধ্ করেছি, তখনই একটা নতুন রেখা টেনে দিয়েছি দেয়ালে। হিসাব রাখতে সুবিধে হয় তাই। প্রায়ই দেখি। গুনি। তিন শ বাহাত্তর, তিহাত্তর, চুয়াত্তর। পুরো দেয়ালটা কবে ভরে যাবে সে প্রতীক্ষায় আছি।
আমাদের যারা মরেছে। তাদের হিসাবও রাখি। কিন্তু সেটা মনে মনে। মনের মধ্যে অনেকগুলো দাগ। সেটাও মাঝে মাঝে গুনি।
খবর পেয়েছি মা, বাবা, ভাই, বোন ওরা সবাই কোথায় যেন চলে গেছে। হয়তো কোনো গ্রাম, কোনো গঞ্জে। কোনো উদ্বাস্তু শিবিরে। কিংবা—
না। ওটা আমি ভাবতে চাই না।
শুধু জানি, এ যুদ্ধে আমরা জিতব। আজ, নয় কাল। নয়তো পরশু।
একদিন আমি আবার ফিরে যাব। আমার শহরে, আমার গ্রামে। তখন হয়তো পরিচিত অনেক মুখ সেখানে থাকবে না। তাদের আর দেখতে পাব না আমি। যাদের পাব তাদের প্রাণভরে ভালোবাসব।
যারা নেই কিন্তু একদিন ছিল, তাদের গল্প আমি শোনাব ওদের।
সেই ছেলেটির গল্প। বুকে মাইন বেঁধে যে ট্যাংকের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।
কিংবা সেই বুড়ো কৃষক। রাইফেলটা হাতে তুলে নিয়ে যে মৃদু হেসে বলেছিল, চললাম। আর ফিরে আসেনি।
অথবা উদ্বাস্তু শিবিরের পাঁচ লাখ মৃত শিশু।
দশ হাজার গ্রামের আনাচ-কানাচে এক কোটি মৃতদেহ।
আরো পড়ুন : জহির রায়হান, একটি ফোনকল, আর না ফেরার গল্প
না এক কোটি নয়, হয়তো হিসাবের অঙ্ক তখন তিন কোটিতে গিয়ে পৌঁছেছে।
এক হাজার এক রাত কেটে যাবে হয়তো। আমার গল্প তবু ফুরাবে না।
কৃতজ্ঞতা : জহির রায়হান