লুকা মদ্রিচ: শরণার্থী থেকে ব্যালন ডি’অর জয়ী এক ফুটবলার
ফুটবল বিশ্বে মেসি-রোনালদোর রাজত্বের আগে শেষবার অন্য কেউ ব্যালন ডি’অর জিতেছিল ২০০৭ সালে। তারপর দীর্ঘ দশ বছর এই দু’জন ছাড়া আর কেউ সেরা খেলোয়াড়ের এই খেতাব জেতেনি। দশ বছর পর তাদের এই রাজত্বে ভাগ বসান এক ক্রোয়েশিয়ান মিডফিল্ডার। চ্যাম্পিয়ন্স লিগে ক্লাবের হয়ে এবং বিশ্বকাপে দেশের হয়ে মাঠে অসাধারণ ঝলক দেখিয়ে ২০১৮ সালে ব্যালন ডি’অর জেতেন রিয়াল মাদ্রিদ মিডফিল্ডার লুকা মদ্রিচ ।
সংঘাতের মধ্যেই বেড়ে ওঠা
সাবেক যুগোস্লোভিয়ার মদ্রিচি গ্রামে ১৯৮৫ সালে লুকা মদ্রিচের জন্ম। তার বাবা-মা কাজ করতেন টেক্সটাইলে। লুকা দিনের বেশিরভাগ সময় তার দাদার সাথেই কাটাতেন। দেশের অবস্থা তখন বেশ খারাপ ছিল। লুকার বয়স যখন পাঁচ, যুগোস্লোভিয়া থেকে স্বাধীন হলো ক্রোয়েশিয়া। স্বাধীনতার দুই মাস পর হঠাতই পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে উঠল। ক্রোয়েশিয়ার স্বাধীনতাবিরোধী এক দল সার্বিয়ান এসে হত্যাযজ্ঞ চালাল গ্রামে। তাদের হাতে নিহত হলেন লুকা মদ্রিচের দাদা। তাদের ঘর পুড়িয়ে দিল দুর্বৃত্তরা। এরকম বর্বরতার পর আর দেশে থাকার মতো অবস্থা ছিল না।
মদ্রিচ তার বাবা-মা সহ পালিয়ে গেলেন নিকটস্থ জাডার শরণার্থী শিবিরে। হোটেল কোলোভারের (পরবর্তীতে হোটেল ইজ নামকরণ হয়) সেই শরণার্থী শিবিরেই নিজের ছোটবেলার বিরাট একটা অংশ কাটে লুকা মদ্রিচের। হোটেলে ইলেক্ট্রিসিটি ছিল না, সবসময় পানি পাওয়া যেত না। হোটেলের পার্কিংয়ে মদ্রিচ যখন নিজের পুরাতন ফুটবল নিয়ে একা একা খেলতেন, দূর থেকে কানে আসত বন্দুকের গুলির শব্দ, গ্রেনেড বিস্ফোরনের আওয়াজ এবং মাইন ফাটার শব্দ।

গোলাবারুদের মাঝে থেকেও ফুটবল খেলা থেমে থাকেনি লুকা মদ্রিচ। কিন্তু সব মিলিয়ে পরিস্থিতি খুব একটা অনুকূলে ছিল না। ছোটখাটো দৈহিক গড়নের কারণে নিজের স্বপ্নের ক্লাব হাজদুক স্প্লিট দলে জায়গা পাননি তিনি। ফুটবল খেলার স্বপ্ন ক্রমেই মনে হচ্ছিল যেন স্বপ্নই থেকে যাবে। এরকম অবস্থায় তাকে যিনি সার্বক্ষণিক সমর্থন দিয়ে গেছেন, তিনি হলেন তমিস্লাভ বাসিচ, এনকে জাডারের কোচ।
ফুটবল জগতে পা
দৈহিক গড়নে কিছুটা খাটো হবার কারণে ফুটবল খেলাটা বরং তার জন্য আরও সহজ হয়ে যায়। বল পায়ে খুব সহজেই ঘুরে যেতে পারতেন। লম্বা খেলোয়াড়দের মাঝ দিয়ে অনায়াসে পার হয়ে যেতে পারতেন বল নিয়ে। কড়া ট্যাকলেও তাকে পরাস্ত করা খুব একটা সহজ কাজ ছিল না।

বয়স যখন ১৬, মদ্রিচ ডাক পান ডায়নামো জাগরেব দলে। সেখানেও যাত্রা প্রথমদিকে খুব একটা শুভ ছিল না। প্রথম কয়েক বছর মদ্রিচকে ধারে খেলতে হয়েছিলো জ্রিঞ্জস্কি মোস্টার (বসনিয়া এন্ড হার্জগোভিনার ক্লাব) এবং ইন্টার জাপ্রেসিক (জাগরেবের শহরতলী অঞ্চলের ক্লাব) এর মতো ছোটখাটো দলে। সেই ক্লাবে নিজের প্রতিভার ঝলক দেখিয়ে ডায়নামো জাগরেব দলে জায়গা করে নিতে খুব বেশী সময় লাগেনি মদ্রিচের। জ্রিঞ্জস্কির হয়ে খেলার সময় বসনিয়া-হার্জগোভিনার সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হন মদ্রিচ।
১৮ বছর বয়সে ডায়নামো জাগরেব হয়ে দশ বছরের চুক্তিতে আবদ্ধ হন মদ্রিচ। নতুন চুক্তিবদ্ধ হয়ে মদ্রিচ সবার আগে নিজের পরিবারের জন্য একটি ফ্ল্যাট কিনেছিলেন, যাতে তার পরিবারকে আর শরণার্থী হয়ে না থাকতে হয়।

অবশেষে ২০০৫ সালে জাগরেব দলে অভিষেক হয় তার। নিজের প্রথম তিন মৌসুমে জাগরেবের হয়ে জিতেন টানা তিনটি লিগ। ২০০৭ সালে মদ্রিচ নির্বাচিত হন ক্রোয়েশিয়ার সেরা খেলোয়াড় হিসেবে।
জাতীয় দলে মদ্রিচ
জাতীয় দলের হয়ে বয়সভিত্তিক দলে খেলার পর ২০০৬ সালের মার্চে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে আন্তর্জাতিক মঞ্চে মদ্রিচের অভিষেক হয়। ২০০৬ বিশ্বকাপে বদলি হিসেবে নেমে দুটি ম্যাচও খেলেন তিনি।

কোচ স্লাভেন বিলিচের অধীনে ২০০৮ ইউরোতে জায়গা করে নেন ক্রোয়েশিয়া জাতীয় দল। শুধু তাই নয়, নিজেরা কোয়ালিফাই হওয়ার পাশাপাশি ইংল্যান্ডের কোয়ালিফাই হওয়ার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল দলটি। সেই বাঁধা পেরোতে পারেনি ইংল্যান্ড দল। ইউরোর প্রথম ম্যাচে সহ আয়োজক দেশ অস্ট্রিয়াকে হারানো ম্যাচটিতে পেনাল্টি থেকে গোল করেন মদ্রিচ। জার্মানির বিপক্ষে ম্যাচটিও মাঠে নিজের নৈপুণ্য দেখিয়েছিলেন তিনি।
কোয়ার্টার ফাইনালে তুর্কির মুখোমুখি হয় মদ্রিচদের দল। ম্যাচ গড়ায় টাইব্রেকারে। ৩-১ গোলে হেরে টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নেয় ক্রোয়েশিয়া।
ইউরোপের বড় মঞ্চে
ততদিনে ক্রোয়েশিয়ান ইয়াং ট্যালেন্ট হিসেবে বেশ নাম ছড়িয়ে পড়েছে মদ্রিচের। টটেনহাম হটস্পারের পাশাপাশি বার্সেলোনায় যোগ দেয়ার ব্যাপারেও গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল।

২০০৮ সালে মদ্রিচ যোগ দেন টটেনহাম হটস্পারে। স্পার্সের হয়ে শুরুটা বেশ ম্যাড়ম্যাড়ে হলেও হ্যারি রেডন্যাপের আসার পর নিজেকে মেলে ধরার সুযোগ হাতছাড়া করেননি মদ্রিচ। স্পার্সে চার বছর কাটানোর পর স্পার্সকে প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়ন্স লিগে নিয়ে যান মদ্রিচ।
পঞ্চাশ বছরের মধ্যে সেবার প্রথমবার চ্যাম্পিয়ন্স লিগ খেলার সুযোগ হয়েছিল টটেনহাম হটস্পারের। রাফায়েল ভ্যান ডার ভার্ট এবং গ্যারেথ বেলের সাথে মিলে স্পার্সকে কোয়ার্টার ফাইনালে নিয়ে গিয়েছিলেন মদ্রিচ।

মদ্রিচের এই খেলা নজর কাড়ে রিয়াল মাদ্রিদের। ২০১২ সালের আগস্ট মাসে লুকা মদ্রিচ যোগ দেন রিয়াল মাদ্রিদে।
মাদ্রিদের ইউরোপ জয়ের তুর্কি
মাদ্রিদে এসে খাপ খাইয়ে নিতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল মদ্রিচের। মাঠে তেমন একটা সুবিধা করতে পারছিলেন না। মাদ্রিদভিত্তিক স্প্যানিশ পত্রিকা মার্কা একটা জরিপ করে ২০১২ সালের লালিগার সবচেয়ে বাজে সাইনিং নির্বাচনে। সেই পোলের ভিত্তিতে মাদ্রিচ সেবার লালিগার সবচেয়ে বাজে সাইনিং নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯ ম্যাচ খেলে মাত্র এক গোল করে, গড়ে প্রতি ম্যাচে মাত্র ৩৮ মিনিট খেলা মদ্রিচের পিছনে পেরেজের খরচ করা ৪০ মিলিয়ন জলে গিয়েছিল বলে মনে হচ্ছিল।

পরের মৌসুমে মাদ্রিদের কোচ হয়ে আসেন কার্লো আনচেলত্তি। সাথে স্পার্স থেকে আসেন মদ্রিচের পুরনো সাথী গ্যারেথ বেল। এরপর আর মাঠে ভুগতে হয়নি মদ্রিচকে। আনচেলত্তির মাদ্রিদের অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠেন তিনি। অভিষেক মৌসুমে গড়ে ৩৮ ম্যাচ খেলা মদ্রিচ ২০১৪ চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে নগর প্রতিদ্বন্দ্বী এটলেটিকো মাদ্রিদের বিপক্ষে খেলেছেন পুরো ১২০ মিনিট। এক মৌসুম পর মাদ্রিদের কোচ হয়ে আসেন তাদেরই কিংবদন্তি খেলোয়াড় জিনেদিন জিদান।
জিদানের অধীনে টনি ক্রুসের সাথে মিলে মিডফিল্ডে দারুণ এক জুটি গড়ে তুলেন মদ্রিচ। জিদানের মাদ্রিদ ২০১৫/১৬ থেকে ২০১৭/১৮ টানা তিন মৌসুমে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতে। ২০১৭ চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালটি ছিলো এই যুগে মাদ্রিদের এখন পর্যন্ত সেরা পারফর্মেন্স। সেই ফাইনাল রিয়াল মাদ্রিদ জিতেছিল ৪-১ গোলে।

রিয়াল মাদ্রিদের শেষ চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনাল ছিলো ২০১৭/১৮ মৌসুমে। কিয়েভে লিভারপুলকে ৩-১ গোলে হারানোর মধ্য দিয়ে নতুন এক রেকর্ড করেন মদ্রিচ। পাঁচ মৌসুমে চার চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালের পুরো ম্যাচ খেলেছেন মদ্রিচ।
ক্রোয়েশিয়ার স্বপ্নের বিশ্বকাপ যাত্রা
২০১২ ইউরো এবং ২০১৪ বিশ্বকাপে দুবারই ক্রোয়েশিয়ার যাত্রা শেষ হয়ে গিয়েছিলো গ্রুপ স্টেজে। তবে ২০১৬ ইউরোতে তুর্কির সাথে নিজের পুরনো হিসাব মিটিয়ে নিয়েছেন মদ্রিচ। তার অভিষেক বিশ্বকাপে তুর্কির কাছে হেরে বাদ পড়েছিল ক্রোয়েশিয়া। এবারের টুর্নামেন্টে তুর্কির বিপক্ষে ভলিতে দারুণ এক গোল করে শুভ সূচনা করেন টুর্নামেন্টের। সেই টুর্নামেন্টে বেশ ভালো খেললেও বেশিদূর যাওয়া হয়নি মদ্রিচদের। শেষ ১৬ তে পর্তুগালের সাথে এক্সট্রা টাইমে যাওয়া ম্যাচ হেরে গিয়ে শিরোপাস্বপ্নের সমাধি ঘটে সেখানেই।

মদ্রিচের জেনারেশনের জন্য দেশের হয়ে কিছু জেতার শেষ সুযোগ ছিল ২০১৮ বিশ্বকাপ। গ্রুপ ডি’তে লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনার সাথে এক গ্রুপে পড়েছিল ক্রোয়েশিয়া। কিছূটা ভয় তো ছিলই। তবে সেই ভয়কে পাত্তা দেয়নি মদ্রিচের দল। নাইজেরিয়াকে ২-০ গোলে হারানো থেকে শুরু করে মেসির আর্জেন্টিনাকে ৩-০ গোলে হারানো প্রতি ম্যাচেই দুর্দান্ত পারফর্মেন্স দেখিয়েছেন মদ্রিচ।
আরো পড়ুন : প্রজেক্ট বিগ পিকচার: ইংলিশ ফুটবলে জমিদারি প্রথা?
সেমিফাইনালে ক্রোয়েশিয়া মুখোমুখি হয় সেই বিশ্বকাপের ফেভারিট তারকা খচিত দল ইংল্যান্ডের। মাত্র পাঁচ মিনিটেই পিছিয়ে পড়া সেই ম্যাচ ক্রোয়েশিয়া টেনে নিয়ে গিয়েছিল এক্সট্রা টাইমে। ২০০৮ ইউরোতে ইংল্যান্ডকে কোয়ালিফাই করতে দেয়নি ক্রোয়েশিয়া। ২০১৮ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের ফাইনালে উঠার পথ আটকে দেয় ক্রোয়েশিয়া।

ফাইনালে মদ্রিচরা মুখোমুখি হন ফ্রান্সের। তবে তাদের গতির কাছে পেরে উঠেনি ক্রোয়েশিয়া। বেশ ভালো লড়াই করেও ৪-২ গোলে হেরে যায় মদ্রিচ-রাকিটিচদের দল। তবে এই টুর্নামেন্ট থেকে খালি হাতে ফেরত যাননি মদ্রিচ। টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় হিসেবে গোল্ডেন বল জিতে নেন এই ক্রোয়েশিয়ান জাদুকর।

ক্রোয়েশিয়া দলকে ফাইনালে তোলার আগে রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে কাটিয়েছেন দারুণ এক মৌসুম। টানা তৃতীয়বারের মতো রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে জিতেছিলেন চ্যাম্পিয়ন্স লিগ। নিজের কাজের ফলও পেলেন তিনি। ২০১৮ সালে ৩৩ বছর বয়সে মেসি-রোনালদোকে পেছনে ফেলে ব্যালন ডি’অর জেতেন লুকা মদ্রিচ। ২০১৭/১৮ মৌসুমের উয়েফার সেরা খেলোয়াড়ও নির্বাচিত হন ক্রোয়েশিয়ার এই খেলোয়াড়।

আট বছর আগে মাদ্রিদে এসেছিলেন। যাত্রা শুরু হয়েছিল ২০১২ সালের আগস্টে। মাদ্রিদিস্তা হিসেবে মোটামুটি সব কটি শিরোপাই জেতা হয়েছে তার। চারবার জিতেছেন চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, দুবার জিতেছেন স্প্যানিশ লিগ, তিনবার জিতেছেন স্প্যানিশ সুপার কাপ। ব্যাক্তিগত অর্জনও কিছু কম নয়। ব্যালন ডি’অর, উয়েফা সেরা খেলোয়াড় তো আছেই। পাঁচবার জিতেছেন ক্রোয়েশিয়ার সেরা খেলোয়াড়ের খেতাব। ৩৫ বছর বয়সে যখন খেলোয়াড়েরা খেলা ছেড়ে দেয়ার চিন্তাভাবনা করে, সেখানে এখনো মাদ্রিদের হয়ে মাঠ দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন এই ক্রোয়েশিয়ান জাদুকর।
This is a Bangla Article about Luka Modric’s football career.
Feature Image: Dw
References:
-
Real Madrid star story, from being a refugee to winning the Ballon D’or
- Luka Modric is former refugee whose granddad was shot dead when he was six but still became a Real Madrid superstar
- War, poverty and tattered footballs: The remarkable story of Luka Modric’s humble upbringing
- MODRIC, 8 YEARS AT REAL MADRID