বিভিন্ন ধর্মের অদ্ভুত সব সত্ত্বা (ভিডিও)
মিস্টিসিজম বা রহস্যবাদ শব্দটির সাথে পরিচয় আছে আপনাদের? বহু বছর ধরে, জাতি, সম্প্রদায় এবং ব্যক্তিরা একটি সুনির্দিষ্ট ধর্মের খোঁজ করতে গিয়ে দ্বন্দ্বে জড়িয়েছে। কার ধর্ম বা ধর্মের সত্ত্বা টি অধিকতর গ্রহণযোগ্য কিংবা কোন ধর্ম পরম শান্তির কথা বলে- এ নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের মধ্যে মত পার্থক্য বা বাগবিতণ্ডার ইতিহাস বেশ পুরনো। মিস্টিসিজম শব্দটিও বেশ সাদৃশ্যপূর্ণ এই বিষয়ের সাথে। বাংলায় একে বলা হয় রহস্যবাদ ।
বিশ্বের প্রায় সব মহান ধর্মেই রহস্যবাদের ঐতিহ্য রয়েছে। কোনো কোনো ধর্মে তো এর অবস্থান প্রায় হাজার বছর ধরে।
পৃথিবীতে নানান ধর্মে বিশ্বাসী মানুষ রয়েছেন। একেক মানুষের আবার তার ধর্মের প্রতি বিশ্বাসের ধরণ বা দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা। আধুনিক প্রযুক্তির এই যুগে দেশ থেকে দেশ কিংবা পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে মানুষের যাওয়া আসা কিংবা নিয়মিত যোগাযোগ সহজলভ্য হয়ে ওঠেছে। ফলে ভিন্ন সংস্কৃতির সাথেও পরিচয় ঘটছে। এক ধর্মীয় মতবাদে বিশ্বাসী মানুষেরা অন্য ধর্মাবলম্বীদের সংস্পর্শে এসে বিভিন্ন ইস্যুতে নিজেদের ভাবনার সংমিশ্রণ ঘটাচ্ছে। তবু জ্ঞান, বিশ্বাস আর সংস্কৃতির অনন্যতায় একেকটি ধর্ম ঠিকই তার জায়গা করে নিয়েছে মানুষের মনে।
রহস্যবাদের ধারণাটিতে ফেরা যাক। রহস্যবাদকে জীবনের অধ্যয়ন হিসাবে চিহ্নিত করা যেতে পারে, যার দ্বারা একজন ব্যক্তি জীবনের আধ্যাত্মিক বাস্তবতা এবং গভীর নীতির উপলব্ধি করতে সক্ষম হন।
রহস্যবাদ, খ্রিস্টের জন্মের পূর্ববর্তী শতাব্দীগুলোতে, বাস্তবতার পুরো সমস্যাটির জন্য একটি বিশেষ ধরণের দৃষ্টিভঙ্গি বোঝাতো। সব ধর্মের ভিত্তিই কি এই রহস্যবাদ, সেটি নিয়েও আছে মতপার্থক্য। এই ধারণাটি দর্শন, কবিতা, শিল্প এবং সংগীতের অনুপ্রেরণা হয়েও টিকে আছে।
এবার রহস্যবাদকে কিছু বাস্তবতার সাথে যোগসূত্র ঘটানো যায় কি-না দেখা যাক।
আচ্ছা, ইসলাম ধর্মের সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর মেরাজের ঘটনাটি নিশ্চয়ই আপনার অজানা নয়? কিংবা খ্রিস্টান ধর্মে উল্লেখ করা যীশু খ্রীষ্টের পুনরুত্থানের ঘটনাটি? বা হিন্দু ধর্মে রামকৃষ্ণ নামে এক ব্যক্তির রহস্যময় অভিজ্ঞতা অর্জনের ব্যাপারখানা? অথবা বৌদ্ধ ধর্মে গৌতমের বুদ্ধতে রূপান্তর হওয়াটা? কি মনে হয় আপনার? রহস্যবাদ অভিজ্ঞতার উদাহরণ হতে পারে এসব?
এই প্রশ্নগুলোর অবশ্যই সুনির্দিষ্ট উত্তর রয়েছে, যদিও অর্থগুলো সর্বজনীন হতে পারে না। কারণ এক ধর্মে বিশ্বাসী মানুষ অন্য ধর্মের রহস্যবাদে তেমন একটা আগ্রহী নয়।
আচ্ছা, একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছেন? যে চারটি ধর্মের ঘটনা উল্লেখ করা হলো সেগুলোর সরাসরি স্রষ্টার সাথে সম্পৃক্ততা আছে। তার মানে কী দাঁড়ালো? রহস্যবাদের প্রশ্নে স্রষ্টার একটি যোগসূত্র থাকবেই।
রাসূল(সাঃ) এর মেরাজের ঘটনায় আলোকপাত করা যাক এবার।
এক রাতে রাসূল (সা.) ঘুমিয়েছিলেন। হঠাৎ হযরত জিবরাইল (আ.) এসে রাসূল (সা.)কে নিয়ে ঊর্ধ্বে আকাশে গমন করতে থাকেন। একের পর এক আসমান অতিক্রম করার সময়ে রাসূলের সাথে হযরত মূসা (আ.)সহ অনেক নবীর সাক্ষাৎ হয়। সপ্তম আসমানের পর তিনি একাই আল্লাহ’র দরবারে হাজির হন।
আল্লাহর সাথে সাক্ষাত্কালে রাসুল (সাঃ) আল্লাহর কতটা নিকটবর্তী ছিলেন সে সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে,
“ফলে, তাদের মধ্যে দুই ধনুকের ব্যবধান রইল।” (সূরা নাজম্ : আয়াত ৯)
আল্লাহকে স্বচক্ষে দেখার এই সৌভাগ্য এর আগে বা পরে আর কোনো ব্যক্তির হয় নি। সামনে উপস্থিত স্বত্ত্বাকে স্বচক্ষে অবলোকন ভাষায় বা বর্ণনায় প্রকাশ করা যায় না। শুধু অনুভব করা যায়। রাসূলও তাই করেছিলেন। সেই স্বত্ত্বাটাই নিঃসন্দেহে আল্লাহ।
রহস্যবাদের ধারণাটি এমনই।
অন্য ধর্মগুলোয় একটু নজর দেয়া যাক।
ইস্টার সানডে। খ্রীষ্টান সম্প্রদায়ের অন্যতম উৎসব। এ দিনে যীশুর পুনরুত্থান ঘটে। তখনকার ইহুদী রীতি অনুযায়ী মেরী ম্যাগডালিন যীশুর কবরগুহায় যান। উদ্দেশ্য মৃতদেহে সুগন্ধী মাখানো। কিন্তু তিনি দেখেন কবরশূন্য, কেউ নেই। এরপর ত্রাণকর্তা যীশু বিভিন্ন স্থানে শিষ্যদের দেখা দেন। তাদের শিক্ষা দেন। যীশুর পুনরুত্থানের এ দিনটি হল ইস্টার সানডে।
নিউ টেস্টামেন্টের অন্যতম শিক্ষা হল যীশুর পুনরুত্থান। সে দিক থেকে দিবসটি খ্রীষ্টান বিশ্বাসের একটি ভিত্তিমূল। খ্রীষ্টানরা মনে করেন, এর মাধ্যমে যীশুর ঈশ্বরের পুত্রত্বের দাবি প্রতিষ্ঠিত হয়। একই সঙ্গে মৃত থেকে যীশুর পুনরুত্থান জগৎকে নতুন আশা দেয়। মানুষের মুক্তি বার্তাকেই নতুনভাবে জানান দেয়। এ হল মানব জীবনের আধ্যাত্মিক পথের নতুন দিগন্ত। রহস্যবাদের ভিত্তিটাও এখানেই।
হিন্দুধর্মে রামকৃষ্ণের কথা বলতে চাই। বহু বছর আগে পশ্চিম ভারতে এক গুরু ছিলেন। তিনি তাঁর মৃত্যুর আগে তিনজন শিষ্য বানিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। সে লক্ষ্যে ৪২ বছর ধরে তিনি পথে পথে বেরিয়েছেন। দুইজন শিষ্যকে দীক্ষাও দিয়েছেন। তৃতীয় জন হিসেবে তিনি বেছে নেন রামকৃষ্ণকে। রামকৃষ্ণকে তিনি মাত্র ৩ দিন দীক্ষা দিয়েছিলেন। এরপর রামকৃষ্ণ অজ্ঞান হয়ে পড়েন। তাঁর শ্বাসও চলছিল না। এভাবে দেড় দিন অতিবাহিত হয়। পরবর্তীতে পানি ও কিছু খাবার দেয়ার পর তাঁর জ্ঞান ফেরে। তাঁর গুরু অবাক হয়েছিলেন, অন্য দুইজনকে যে দীক্ষা দিতে ৪২ টি বছর কেটেছে, সেখানে রামকৃষ্ণের লেগেছে মাত্র ৩ দিন।
বৌদ্ধ ধর্মের কথায় আসি এবার। গৌতম বুদ্ধ। প্রাচীন ভারতের এই ধর্মগুরু এবং তাঁর দ্বারা প্রচারিত ধর্ম বিশ্বাস ও জীবন দর্শনকে বৌদ্ধ ধর্ম বলা হয়।
বলা হয়ে থাকে, ২৯ বছর বয়সে একদিন গৌতম বেড়াতে বের হলে ৪ জন ব্যক্তির সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। প্রথমে তিনি একজন বৃদ্ধ মানুষ, অতঃপর একজন অসুস্থ মানুষ, এবং শেষে একজন মৃত মানুষকে দেখতে পান। তিনি তাঁর সহিস চন্নকে এ প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করলে, চন্ন তাঁকে বুঝিয়ে বলেন যে এটিই সকল মানুষের নিয়তি। একই দিন কিংবা অন্য একদিন তিনি দেখা পেলেন একজন সাধুর, যিনি মুণ্ডিতমস্তক এবং পীতবর্ণের জীর্ণ বাস পরিহিত।
চন্নকে এঁর সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করলে, তিনি বলেন উনি একজন সন্ন্যাসী যিনি নিজ জীবন ত্যাগ করেছেন মানুষের দুঃখের জন্য। গৌতম সেই রাত্রেই ঘুমন্ত স্ত্রী, পুত্র, পরিবারকে নিঃশব্দ বিদায় জানিয়ে প্রাসাদ ত্যাগ করেন।
এরপর গৌতম বিভিন্ন স্হানে গিয়েছেন, সাধনা করেছেন। দীর্ঘকাল ধরে কঠোর তপস্যার পর তার শরীর অস্থিচর্মসার হয়ে পড়ে ও তার অঙ্গসঞ্চালনের ক্ষমতা কমে গিয়ে তিনি মরণাপন্ন হলে তার উপলব্ধি হয় যে, অনশনক্লিষ্ট দুর্বল দেহে শরীরকে অপরিসীম কষ্ট দিয়ে কঠোর তপস্যা করে বোধিলাভ সম্ভব নয়। এরপর একটি অশ্বত্থ গাছের তলায় তিনি ধ্যানে বসেন এবং সত্যলাভ না করে স্থানত্যাগ করবেন না বলে প্রতিজ্ঞা করেন। ৪৯ দিন ধরে ধ্যান করার পর তিনি বোধি প্রাপ্ত হন। এই সময় তিনি মানব জীবনে দুঃখ ও তার কারণ এবং দুঃখ নিবারণের উপায় সম্বন্ধে অন্তর্দৃষ্টি লাভ করেন, যা চতুরার্য সত্য নামে খ্যাত হয়।
আমরা একেবারে শেষে চলে এসেছি। স্রষ্টা এক রহস্যময় সত্ত্বা। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রহস্যময় ঘটনার ইতিহাস প্রমাণ করেছে যে স্রষ্টার অস্তিত্ব আছে। যীশু, মুহাম্মদ (সাঃ), রামকৃষ্ণ এবং বুদ্ধ যে রহস্যময় অভিজ্ঞতাগুলোর সাথে নিজেদেরকে যুক্ত করেছিলেন সেটি তাঁদের নিজ নিজ ধর্মের উপর বিশাল প্রভাব ফেলেছিল।
আরো পড়ুন : দাজ্জাল: কিয়ামতের সবচেয়ে বড় আলামত (ভিডিও)
তাই ধরে নেয়া যায়, রহস্যবাদ সমস্ত ধর্মের মূল ভিত্তি হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। আমাদের অতীতের আধ্যাত্মিক নেতারা যে রহস্যময় অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন তা সারা বিশ্বের মানুষকেই উপকৃত করেছে। রহস্যবাদের ধারণা বা উপলব্ধির মধ্য দিয়ে পৃথিবীর সব ধর্মের মানুষের মধ্যে পারস্পরিক শান্তি ও সম্প্রীতির বন্ধন অটুট থাকুক।
reference :
1. Journal