দেশের প্রথম মেট্রোরেল : ৩ ঘন্টার পথ মাত্র ৩৫ মিনিটে!
ভাইসব ভাইইইইসবববব – আসিতেছেএএএএএ। আর নয় যানজট, আর নয় ঝক্কি! ঠুশশ করে উঠবেন আর ফুশশ করে পৌঁছে যাবেন আপনার কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে! আসিতেছে আসিতেছেএএএএ। দেশের প্রথম মেট্রোরেল আসিতেছে।
যানজটের শহর ঢাকার পল্লবীতে গেলেই চোখে পড়বে উড়ালপথ। মূল সড়ক থেকে প্রায় ১৩ মিটার উঁচুতে এই পথে বসছে রেললাইন। চলছে স্টেশন নির্মাণের কাজ। এগুলো মেট্রোরেলের নির্মাণযজ্ঞের অংশ। শুধু পল্লবী নয়, এর আগে-পরে প্রায় ১২ কিলোমিটার মেট্রোরেলের পথের এমন দৃশ্য চোখে পড়বে সবার।

প্রায় এক কোটি ৪৫ লাখ লোকের বসবাস রাজধানী শহর ঢাকায়। বিপুল এ লোকজনের শহরে যানজট নিরসনে কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা নিয়েছে ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ।
এই পরিকল্পনার আওতায় এই কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ সরকার ও জাইকার অর্থায়নে দেশের প্রথম মেট্রোরেল প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। ২০১৬ সালে এই প্রকল্পের মূল কাজ শুরু হয়।
ভাবুন তো, এতদিন দেশের বাইরে কিংবা নানান সিনেমায় যে ট্রেন দেখে এসেছেন, যে ট্রেন এ দেশের মানুষের কাছে স্বপ্নের মতো ছিল, সেটিই চালু হয়ে যাচ্ছে এ বছর! পদ্মা সেতুর পর আরেকটি গর্বের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ।
রাজধানীর উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত উড়ালপথে মেট্রোরেলের দূরত্ব ধরা হয়েছে ২০ দশমিক ১০ কিলোমিটার। চালু হওয়ার কথা আসছে ডিসেম্বরেই।
প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছে ২২ হাজার কোটি টাকা। এর সিংহভাগই দিচ্ছে জাপানের আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা জাইকা। বাকিটা বাংলাদেশ সরকার বহন করছে।

মেট্রোরেলের কাজকে মূলত আট ভাগে ভাগ করা হয়েছে। উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত উড়ালপথ ও স্টেশন নির্মাণ, ডিপো তৈরি এবং বিদ্যুৎ-ব্যবস্থা ও রেললাইন বসানো এবং ইঞ্জিন কোচ সংগ্রহ সংক্রান্ত কাজগুলো বিভক্ত। সবগুলো ভাগের কাজই সমানতালে চলছে, অগ্রগতিও বেশ আশা জাগানিয়া।
মেট্রোরেলে ২৪ সেট ট্রেন চলাচল করবে। আচ্ছা, এখন কতক্ষণ লাগে উত্তরা থেকে মতিঝিল যেতে? জ্যামের নগরীতে জ্যাম আর বাস বিবেচনায় বোধহয় ঘন্টা তিনেক লেগে যায়, তাই না? কিন্তু একই সময়ে আপনি যদি ৩ বার আসা যাওয়া করতে পারেন, ব্যাপারটা দারুণ হবে না? সেই দারুণ ব্যাপারটাই ঘটাতে যাচ্ছে মেট্রোরেল। মেট্রোরেলে চড়ে আপনি মাত্র ৩৫ মিনিটে উত্তরা থেকে মতিঝিলে যেতে পারবেন।
আরো পড়ুন : দ্বিতীয় পদ্মা সেতু (ভিডিও)
মেট্রোরেল ট্রেন সেটগুলো জাতীয় পতাকার লাল-সবুজ রঙে রঙ করা থাকবে। ট্রেন সেটের বডি এবং ভিতরের কাঠামোর সবকিছুই স্টেনলেস স্টিলে তৈরি করা হচ্ছে। কোচে ব্যবহৃত গ্লাসগুলো থাকবে বুলেটপ্রুফ।
একেকটি কোচে ১ হাজার ৭৩৮ জন যাত্রী যেতে পারবেন। বাংলাদেশের মানুষ অবশ্য বাসে ট্রেনে দাঁড়িয়ে যেতেও বসার মতোই সমান পারদর্শী। সে বিবেচনায় আশা করাই যায়, একেকটি কোচ এর চেয়েও কয়েক গুণ যাত্রী বহন করবে।
যাত্রী যাতে দাঁড়িয়ে ভ্রমণ করতে পারেন সে ব্যবস্থাও অবশ্য থাকবে। প্রতিটি কোচের দুদিকে চারটি দরজা থাকবে। ট্রেনে সিটগুলো লম্বালম্বি পাতা থাকবে।
প্রতিটি ট্রেনে ৬টি কোচের মধ্যে একটি কোচ শুধুমাত্র নারী যাত্রীদের জন্য সংরক্ষিত রাখা হবে। বাকিগুলোতে নারী পুরুষ উভয়ই একসঙ্গে যেতে পারবেন।
শুরুতে দৈনিক পৌনে পাঁচ লাখের বেশি যাত্রী যাতায়াত করতে পারবে এই ট্রেনগুলোয়।
ঢাকায় মেট্রোরেল চলবে চালক ছাড়াই। তবে প্রথম দিকে কিছুদিন একজন চালক রাখা হবে। ট্রেনগুলো সময়ের সঙ্গে মিলিয়ে নিজস্ব গতিতে চলতে থাকবে। কোথাও কোনো অপেক্ষার সুযোগ থাকবে না। প্রতি চার মিনিট পর পর উত্তরা থেকে কমলাপুর রুটে এবং কমলাপুর থেকে উত্তরা রুটে ট্রেন চলতে থাকবে।
দিনের ট্রেন চলতে শুরু করবে ফজরের আজানের পর থেকে। আজানের সময়ের ভিত্তিতে সময় আগু-পিছু হতে পারে। প্রতিদিন মধ্যরাত ১২টা পযন্ত ট্রেন চলবে।
টিকেট? ট্রেনের গৎবাঁধা টিকেটিং সিস্টেম থাকছে না মেট্রোরেলে। থাকবে স্মার্টকার্ড টিকেটিং পদ্ধতি। এক্ষেত্রে দুই ধরণের টিকেট চালু করা হবে। যখনকার ভ্রমণ তখনের জন্য এবং একটি স্থায়ী টিকেট। ট্রেন স্টেশনে টিকিট বিক্রির মেশিন থাকবে। মেশিনে টাকা ইনসার্ট করে টিকেট কেনা যাবে। মোবাইল অ্যাপ ও ওয়েব এপ্লিকেশনের মাধ্যমে মেট্রোরেলের টিকেট কেনা যাবে।
উত্তরা থেকে কমলাপুর পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ২১ কিলোমিটার পথের মধ্যে মোট ১৭টি স্টেশন থাকবে যেখান থেকে যাত্রী ওঠানামা করতে পারবে। এর মধ্যে উত্তরা সেন্টার, বিজয়স্বরণী ও মতিঝিল স্টেশনকে সুদৃশ্য করে তৈরি করা হবে। বাকি স্টেশনগুলো সাধারণ স্টেশন হবে।
আর ভাড়া?
মেট্রোরেলে প্রতি কিলোমিটারে ভাড়া ২ টাকা ৪০ পয়সা নির্ধারণের বিবেচনা করা হচ্ছে। এই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হলে পুরো পথে মোট ভাড়া আসবে ৪০ টাকা ২৫ পয়সা। কিন্তু এই ভাড়া কি সাশ্রয়ী হবে যাত্রীদের জন্য?
একই পথে যেসব বাস মিনিবাস চলে সেগুলোতে নজর দেয়া যাক। বর্তমানে যাত্রীদের কাছ থেকে বাস মিনিবাসগুলো প্রতি কিলোমিটারে ১ টাকা ৬০ বা ৭০ পয়সা করে ভাড়া নেয়। এ হিসাবে উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ভাড়া আসে ৩০ টাকা মতো। তার মানে সাশ্রয়ী ভাবছেন বাসকেই? কিন্তু সময় আর দূরত্ব যদি বিবেচনায় রাখেন তাহলে বহুগুণে সাশ্রয় হবে মেট্রোরেলে।
পাশ্ববর্তী দেশগুলোর সাথেও একটু তুলনা হোক।
প্রায় ২৮ কিলোমিটারের কলকাতা মেট্রো ভারতের সবচেয়ে পুরোনো। এটিতে ২০-২৫ কিলোমিটার ভ্রমণ করতে ভাড়া গুনতে হয় বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ৩০ টাকা। আর পাকিস্তানের পাঞ্জাবে সাড়ে ২৫ কিলোমিটার লাইনের মেট্রোরেলের জন্য যাত্রীদের ভাড়া দিতে হয় ৪৭ টাকার মতো। এবার বলুন তো কোনটা সাশ্রয়ী?
মেট্রোরেল প্রকল্প প্রতিদিন চালাতে খরচ হবে ২ কোটি ৩৩ লাখ টাকার মতো। প্রতিদিন যদি ৪ লাখ ৮৩ হাজার মানুষ এই রেলসেবা ব্যবহার করে তাহলে খরচ উঠে আসবে।
মেট্রোরেলের এই প্রকল্প বাস্তবায়নের পথ ধরে দেশের অর্থনীতির চাকায় নতুন গতি আসবে- এমনটাই থাকুক প্রত্যাশা।
মেট্রোরেল নিয়ে এই লেখাটির ভিডিও দেখতে ক্লিক করুন ফেসবুকের এই লিন্কে
Source : মেট্রোরেলের যুগে বাংলাদেশ