বিয়ের রীতি শুরু হয় কিভাবে?
বিয়ে শব্দটার ব্যাখ্যা করতে হলে বলতে হয় এটি দুটি মানুষের একসাথে একটি নতুন জীবনের সূচনা। প্রাপ্ত বয়স্ক একজন মানুষ যখন জীবনে চলার পথে আরও একটি মানুষের সাহকারিতা চায় তখন তারা বিয়ের সম্পর্কে আবদ্ধ হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
তবে বিয়ে শুধু দুটো মানুষের মধ্যেকার সম্পর্ক না, এই সম্পর্কে আবদ্ধ হয় দুটো মানুষ, তার সাথে দুটো পরিবার।
তাই তো নাটক, সিনেমায় এই বিয়ে নিয়ে কত ঘটনা, কত গল্প। একে অপরের সুখ দুঃখ ভাগাভাগি করে নেওয়া, প্রয়োজনে আপন মানুষটিকে কাছে পাওয়া, আর তার সাথে মিলে নিজেদের একটি পরিবার সাজানো এই সবকিছুর শুরুই হয় বিয়ে দিয়ে।
কথায় আছে ঈশ্বর সবচেয়ে বেশি খুশি হোন যখন দুটি মানুষ বিয়ের মত একটি পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়। প্রতিটা ধর্মে স্বামীর তার স্ত্রী এর উপর আর স্ত্রী এর তার স্বামীর উপর কিছু দ্বায়িত্ব এবং কর্তব্য নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। তার সবগুলোই তাদের একে অপরের প্রতি ভালবাসা আর শ্রদ্ধাবোধ বাড়ানোর জন্য, মিলেমিশে একসাথে জীবন গড়ার জন্য।

বিয়ে যেই ধর্ম অনুসারেই হোক না কেন এর রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন রীতি আর আনুষ্ঠানিকতা। তবে আমাদের সমাজে বিয়ে হয় কম করে দুটি অনুষ্ঠান করে: হলুদ আর বিয়ে।

এর বাইরেও আমাদের দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ভারত, পাকিস্তান আর বাংলাদেশে বিয়ের মূল আনুষ্ঠানিকতার আগে থাকে দুটো হলুদ (ছেলের ও মেয়ের), বিয়ে এবং বৌভাত। তবে এখন বিভিন্ন সংস্কৃতি অনুসরণ করে হলুদের আগে মেহেদীর অনুষ্ঠান, তার আগে ব্রাইডাল শাওয়ার, ইত্যাদি অনুষ্ঠান করা হয়।যেই বিয়ে নিয়ে মানুষের এত জল্পনা কল্পনা সেই বিয়ের পূর্ব ইতিহাস সম্পর্কে আমরা ক’জনেই বা জানি।
এই বিয়ের প্রথা প্রচলিত হওয়ার আছে ইতিহাস। কেন আমরা বিয়ে করি, আর এই বিয়ের নিয়ম ঠিক কতটা পুরনো?
ইতিহাসের প্রথম বিয়ের প্রমাণ পাওয়া যায় প্রায় ৪,৩৫০ বছর আগে। তার আগের হাজার হাজার বছর মানুষ কোন সম্পর্কের নাম ছাড়াই একসাথে একত্রিত হয়ে তিরিশ জন পর্যন্ত দলবদ্ধ হয়ে থাকতেন। সেই দলে ছিল কয়েকজন পুরুষ যারা দলের নেতৃত্বে থাকতেন, ছিল তাদের সাথে কয়েকজন নারী আর শিশু।
যেহেতু শিকারী সংগ্রহকারীরা কৃষি সভ্যতায় বসতি স্থাপন করা শুরু করেছিল, তাই সমাজের আরও স্থিতিশীল ব্যবস্থার প্রয়োজন হয়। এরপর প্রথম বারের মত মেসোপোটেমিয়ায় একটি পুরুষ ও একটি মহিলাকে একত্রিত করে ২৩৫০ খ্রীস্টপূর্ব সময় তাদের প্রথম বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা করা হয়।

তার পরের কয়েক হাজার বছর ঐতিহাসিক ইব্রীয়, গ্রিক ও রোমানিয়ানরা এই ভাবেই তাদের নারী পুরুষের মাঝে বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হয়ে আসছিলেন। তবে সেই সময় বিয়ের মাঝে ভালবাসা আর ধর্মের কোন ভেদাভেদ ছিল না।
তাহলে তখন বিয়ে হতো কি বিবেচনা করে?
সেই সময় বিয়ের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল একটি নারীকে একটি পুরুষের সাথে আবদ্ধ করা এবং এটা নিশ্চিত করা যে নারীর গর্ভে শুধু মাত্র সেই পুরুষেরই সন্তান থাকবে এবং সেই সন্তানই হবে তার জৈবিক উত্তরাধিকারী।
বৈবাহিক সম্পর্কের পর সেই নারী হয়ে যেত তার স্বামীর ব্যক্তিগত সম্পত্তি এবং তার স্ত্রী এর প্রতি সব দায়িত্ব হয়ে যেত তার স্বামীর। প্রাচীন গ্রিসের বিবাহোৎসব অনুষ্ঠানে, একজন বাবা এই কথাগুলো বলে তার কন্যাকে হস্তান্তর করতেন:
“আমি আমার মেয়েকে বৈধ সন্তান উৎপাদনের লক্ষ্যে শপথ করছি।”

প্রাচীন ইব্রীয়দের মধ্যে পুরুষরা বেশ কয়েকটি স্ত্রী গ্রহণ করতে পারত। বিবাহিত গ্রীক এবং রোমানরা উপপত্নী, পতিতা এমনকি কিশোর পুরুষ প্রেমিকদের সাথেও তাদের যৌন আবেদন মেটানোর জন্য নির্দ্বিধায় যেতে পারত, যদিও তাদের স্ত্রীদের ঘরে থাকতে হতো এবং বাড়ির প্রতি ঝোঁক দেওয়াই ছিল তাদের মূল কাজ। স্ত্রীরা যদি সন্তান জন্ম দিতে ব্যর্থ হতো তাহলে তাদের স্বামীরা তাদের ফিরিয়ে দিতেন এবং অন্য কারও সাথে পুনরায় বিয়ে করতে পারতেন।
বিয়ের বন্ধনে ধর্ম আসলো কখন থেকে?
রোমান ক্যাথলিক চার্চ ইউরোপের একটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান হওয়ার সাথে সাথে বিবাহের আইনত স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য পুরোহিতের আশীর্বাদ একটি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপে পরিণত হয়।

অষ্টম শতাব্দীর প্রথম থেকেই, ক্যাথলিক গির্জার মধ্যে বিবাহকে একটি ধর্মবিশ্বাস বা ইশ্বরের অনুগ্রহ দান করার একটি অনুষ্ঠান হিসাবে ব্যাপকভাবে গৃহীত করা হয়। ১৫৬৩ সালে কাউন্সিল অফ ট্রেন্ট-এ, বিবাহকে ধর্মীয় ভাবে ক্যানন আইনে লিখিত করা হয়েছিল।
এই পরিবর্তনটি কি বিয়ের সম্পর্কে কোন রকম প্রভাব ফেলেছে?
চার্চের আশীর্বাদের এই নিয়ম স্ত্রীদের জীবনমাণের অনেক উন্নতি করেছিল। পুরুষদের তাদের স্ত্রীদের প্রতি আরও বেশি শ্রদ্ধা দেখাতে শেখানো হয়েছিল এবং তাদের তালাক দেওয়া নিষেধ করা হয়েছিল। খ্রিস্টান মতবাদ ঘোষণা করেছিল যে স্বামী ও স্ত্রী তারা “দু’টি মন এক দেহ হবে”, এতে স্বামী এবং স্ত্রী উভয়ই একে অপরের উপর সমান অধিকার পেয়েছিল। এটি পুরুষদের উপর যৌনতার দিক থেকে বিশ্বস্ত থাকার জন্য নতুন করে চাপ সৃষ্টি করে। তবে চার্চ তখনও এই নিয়মটি রেখেছিল যে পুরুষরা পরিবারের প্রধান হিসেবেই থাকবেন এবং তাদের স্ত্রীরা তাদের মতামত আর ইচ্ছাকে পিছনে রাখবেন।
বিয়েতে ভালবাসার আবির্ভাব কখন থেকে?
অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি বিয়ের জন্য ভালবাসার প্রয়োজনীয়তা বা ছেলে মেয়ের একে অপরকে ভাল লাগার বিষয়টা অনেক দেরিতে এসেছে। মানব সভ্যতার বেশ অনেকটা সময় জুড়ে নারী পুরুষের বিয়ে দেয়া হত ব্যবহারিক কারনে।
সময়ক্রমে, অনেক দম্পতি তাদের বিয়ের পর তাদের অংশীদারদের প্রতি গভীর পারস্পরিক ভালবাসা এবং নিষ্ঠা অনুভব করতে শুরু করে। কিন্তু বিবাহের অনুপ্রেরণা হিসেবে রোমান্টিক প্রেমের ধারণাটি কেবল মধ্যযুগেরও অনেক পরে এসেছে।

স্বাভাবিকভাবেই, অনেকে বিশ্বাস করেন যে প্রেমের এই ধারণাটি ফরাসিদের দ্বারা আবিষ্কার হয়েছিল। এর মডেল হলেন নাইট যিনি অন্য কারও স্ত্রীর প্রতি তীব্র ভালবাসা অনুভব করেছিলেন। যেমনটা স্যার ল্যানসেলট এবং কিং আর্থারের স্ত্রী কুইন গিনিভারের হয়েছিল।
দ্বাদশ শতাব্দীর সাহিত্য পুরুষদের পরামর্শ দিতো তারা কিভাবে নারীদের আকৃষ্ট করবেন। নারীদের চোখ, চুল এবং ঠোঁটের প্রশংসা করে তাদের আকাঙ্ক্ষার বিষয়টিকে নারীদের কাছে তুলে ধারতে বলা হয়েছিল।

ত্রয়োদশ শতাব্দীতে, ফ্রান্সের রাজার চিকিৎসক, রিচার্ড ডি ফর্নিভাল কিছু প্রেমের পরামর্শ লিখেছিলেন, যাতে তিনি উল্লেখ করেন কোন মহিলা যদি কোন পুরুষের প্রতি আকৃষ্ট হোন তিনি সেই পুরুষের দিকে আনন্দময় দৃষ্টিতে তাকান।
ভালবাসা কি বিয়ের সম্পর্ককে পরিবর্তন করেছে?
অবশ্যই ভালবাসা বিয়েকে দুজনের জন্যই আরও মধুর করেছে। স্ট্যানফোর্ডের ইতিহাসবিদ এবং হিস্টরি অব দি ওয়াইফের লেখিকা ম্যারিলিন ইয়ালোম ভালবাসার এই রোম্যান্টিক সম্পর্ককে নারীদের প্রতি অবিচার রোধের প্রথম ধাপ বলে মনে করেন।
সম্পর্কে ভালবাসার আগমনের পর থেকে নারীরা শুধু মাত্র পুরুষের সেবার জন্য সম্পর্কে টিকে থাকতেন না। এমনকি রোম্যান্টিক রাজপুত্র তার ভালবাসার নারীটির জন্য অনেক কাজও করে দিতেন। ভালবাসা শুরুর পর থেকেই নারীরা পুরুষের নিজস্ব সম্পত্তি এই ধরনের কুসংস্কার আস্তে আস্তে হারিয়ে যেতে শুরু করে।

এরপরও বিয়ের মধ্যে নারী পুরুষের অনেক ধরনের ভেদাভেদ ছিল যা ধীরে ধীরে পরিবর্তন হতে শুরু করে ১৯২০ সালে মহিলাদের ভোট দেওয়ার অধিকার নিশ্চিত করার পর। যদিও তখনও পুরুষদের তাদের বাড়ির নেতার জায়গায় রাখা হয়েছিল।
১৯৬০ এর শেষের দিকে ভিন্ন জাতি একে অপরকে বিয়ে করতে পারবে না এমন আইন তুলে নেওয়া হয়, তার পর পরই জন্ম নিয়ন্ত্রণকে বৈধ করার মত বড় সিদ্ধান্ত গুলো নারীদের পক্ষে নেয়া হয় যার পরে নারী অধিকার অনেকাংশেই স্থিতিশীল হয়েছে। ইতিহাসবিদ ও দি ওয়ে উই নেভার ওয়ের: আমেরিকান ফ্যামিলিস এন্ড নস্টাইলজিয়া ট্র্যাপের লেখিকা স্টেফানি কুন্টজ বলেন গত চল্লিশ বছরে বিয়ের সম্পর্কে যতটা পরিবর্তন এসেছে ততটা গত ৫০০০ বছরেও আসেনি।
যেই পুরুষরা পুরুষদেরই বিয়ে করেন
সমকামী বিয়ে ইতিহাসে বিরল তবে অপরিচিত না। রোমান সম্রাট নেরো, যিনি ৫৪ থেকে ৬৮ সাল পর্যন্ত শাসন করেছিলেন, দুবার পুরুষদের আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে করেন এবং রাজকীয় আদালতকে তাদের স্ত্রী হিসাবে আখ্যায়িত
করতে বাধ্য করেছিলেন।

দ্বিতীয় এবং তৃতীয় শতাব্দীতে রোমে, সমকামী বিবাহ এতটাই সাধারণ হয়ে উঠেছিল যে এটি সামাজিক ভাষ্যকার জুভেনালকে চিন্তিত করেছিল। তিনি অনেকটা উপহাস করেই বলেন, “এ কেমন বউ যারা তাদের স্বামীর নাম আগাতে পারবে না, তাদের গর্ভে কখনো সন্তান জন্ম নিবে না”।

রোমানরা ৩৪২ সালে আনুষ্ঠানিক সমকামী বিয়ে নিষিদ্ধ করেছিল। কিন্তু ইয়েলের ইতিহাসের অধ্যাপক জন বসওয়েল বলেন যে তিনি সেই সময়ের পরেও সমকামী বিয়ের বিক্ষিপ্ত প্রমাণ পেয়েছেন, যার মধ্যে কয়েকটি ক্যাথলিক এবং গ্রীক অর্থোডক্স গীর্জার দ্বারা স্বীকৃত ছিল। একটি ত্রয়োদশ শতাব্দীর গ্রীক অর্থোডক্স অনুষ্ঠানে একই লিঙ্গের দুজনকে একাত্মকতা করার আদেশ দেওয়া হয়েছিল।
This is a Bengali language article on The origins of marriage. Necessary information are hyperlinked in the article.
Reference :The origins of marriage
Images :
-
universal life church
-
gay wedding guide
-
2020 women’s vote centennial initiative
-
the messianic prophecy bible project
-
longreads
-
Ancient origins
-
pinterest
-
familytech
-
weddingsonly
-
WQ