বারান : মাজিদ মাজিদির ‘অধরা‘ রোমান্টিক বৃষ্টি
২০০১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত রোমান্টিক ড্রামা ধাঁচের ‘ বারান ‘ সিনেমাটি ‘চিল্ড্রেন অফ হেভেন‘ খ্যাত প্রখ্যাত ইরানি চলচ্চিত্র পরিচালক মাজিদ মাজিদির অনন্য সৃষ্টি। গোপন হৃদয়াবেগ ও রূঢ় বাস্তবতার মিশেলে নির্মিত মূলত ফার্সি ভাষার দেড় ঘণ্টাব্যাপী সিনেমাটি ১৩টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার অর্জনসহ আরও ভিন্ন পাঁচটি পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয় যার মধ্যে গিজন ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল–এ ‘সেরা চিত্রনাট্য‘ এবং ‘সেরা চলচ্চিত্র পরিচালক‘ ক্যাটাগরির কথা বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
প্রেক্ষাপট ও উৎস
‘বারান‘ সিনেমার প্রেক্ষাপট ১৯৭৯ সালের ইরানে। প্রায় দশ বছর ব্যাপী সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আফগানিস্তান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র এবং আফগান মুজাহিদদের মধ্যে এক তুমুল যুদ্ধ চলছিল তখন। এক জরিপ মতে,এ যুদ্ধ প্রায় বিশ লক্ষের মতো মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয় যার বেশিরভাগই ছিল বেসামরিক আফগান নাগরিক। যুদ্ধের ডামাডোল, ভয়াবহতা ও দুর্ভিক্ষের মুখে লক্ষ লক্ষ আফগান নাগরিক নিজ দেশ ছেড়ে ইরানে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেয়। ভিন্নধারার বাস্তব কাহিনী নির্মাণ জাদুকর মাজিদ মাজিদি যুদ্ধক্লিষ্ট এই পটভূমি থেকেই জন্ম দেন প্রতিদানহীন,নিঃস্বার্থ এক প্রেমাখ্যানের।
কাহিনী সংক্ষেপ
যুদ্ধাক্রান্ত সেই সময়টায় ইরানে উদ্বাস্তু আফগানদের কাজ করার অনুমতি না থাকায় তারা গোপনে কাজ করে জীবন ধারণ করত। রাজধানী তেহরানে এক নির্মাণাধীন সাইটের ঠিকাদার, মেমার ইরানি শ্রমিকদের চেয়ে অপেক্ষাকৃত কম পারিশ্রমিকে উদ্বাস্তু আফগানদের দিয়ে গোপনে নির্মাণ কাজ করাতেন। দুর্ঘটনাক্রমে, একদিন আফগান শ্রমিক নাজাফ দালান থেকে পড়ে পা ভেঙ্গে ফেলে এবং কাজে অক্ষম হয়ে পড়ে।
স্ত্রী–হারা নাজাফের পাঁচ সন্তানের সংসার কোনোমতে চালানোর জন্য নাজাফের বন্ধু, সুলতানের অনুরোধে নির্মাণাধীন সাইটের ঠিকাদার মেমার নাজাফের বিকল্প হিসেব তাঁর চৌদ্দ বছরের বড় ছেলে,রহমতকে সেখানে কাজের সুযোগ দেন।সেই সাইটে সতের বছর বয়সী সরল সাধারণ এক কিশোর,লতিফ শ্রমিকদের খাদ্য পরিবেশন করত। ঠিকাদার মেমারের হুমকি–ধামকি উপেক্ষা করে আর তিন বেলা কোনোরকম খেয়েই সেখানে কাজ চালাচ্ছিল লতিফ।নতুন কর্মী, রহমত আসার পর নিজ কাজ এবং অবস্থানের বেশ পরিবর্তন দেখতে পায় লতিফ যা সে মেনে নিতে পারে না। বেশ ক্ষিপ্ত ও বিরক্ত লতিফ একদিন আশ্চর্যান্বিত হয়ে আবিষ্কার করে ‘রহমত‘ আসলে ছেলের ছদ্মবেশী এক সুন্দরী কিশোরী যার প্রকৃত নাম ‘বারান‘!
এই অস্ফুট আবিষ্কার লতিফের ধ্যান–জ্ঞান, চিন্তা–ধারা সম্পূর্ণ পাল্টে দেয়।প্রেমাচ্ছন্ন এক পৃথিবীতে প্রবেশ করে লতিফ আর সূত্রপাত হয় এক বিরল, নিগূঢ় ভালোবাসার।

পরিচালকের ভাষা, চরিত্রায়ন ও সিনেমাটোগ্রাফি
অভূতপূর্ব ‘নিরব অথচ প্রচন্ড সরব‘ ভালোবাসার রূপটি চৌকস পরিচালক মাজিদ মাজিদির সেলুলয়েডের ফিতায় ধরা পড়েছে কিছুটা ভিন্নভাবে। রোমান্টিকতার স্বরূপ উপস্থাপনে গতানুগতিক সংলাপ,পরিচিত প্রেমের দৃশ্য কিংবা সিনেদৃশ্যে সচরাচর ব্যবহৃত ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশকে পরিহার করেছেন মাজিদি। সিনেমার শুরু থেকেই ভালোবাসার দৃশ্যায়নে কেন্দ্রীয় চরিত্র,লতিফকে ‘দূর হতে তোমারেই দেখেছি‘ পদ্ধতি অবলম্বন করতে দেখলেও শেষ পর্যন্ত দর্শক চোখে ‘তোমারে যে চিনি চিনি‘ রূপেই ধরা পড়েছে কিশোরী বারান। প্রেমিকার প্রতি নিঃস্বার্থ মনোভাব ও নিরব আত্মোৎসর্গের মাধ্যমেই প্রেমিক লতিফ মূলত দূর থেকে ছুঁতে সমর্থ হয়েছিল প্রেমিকা তথা গোটা দর্শক হৃদয়।
দুর্লভ এ ভালোবাসা উপস্থাপনে সিনেমাটির চরিত্রায়নও প্রশংসার দাবি রাখে। ‘লতিফ‘ চরিত্রে ‘হোসাইন আবেদিনী’র অসামান্য অভিনয় এবং ‘বারান‘ চরিত্রে গোটা সিনেমাজুড়ে নিশ্চুপ, সংলাপহীন থাকা জাহরা বাহরামি’র মুখভঙ্গি ও চোখের ভাষা নিঃসন্দেহে দর্শক হৃদয়ে আঁচড় কাটবে।নির্মাণ ঠিকাদার, মেমার চরিত্রে ‘দ্যা সং অফ স্প্যারো‘ খ্যাত মোহাম্মদ আমির নাজি কিছুটা হতাশাজনক,কর্কশ চরিত্রে অভিনয় করেও নির্মাণাধীন শ্রমিক ও সংশ্লিষ্টদের তথা দর্শক মন জিতে নিয়েছেন। আর মাজিদ মাজিদির রচনায় সিনেমার চিত্রনাট্যেকে দর্শকরা ইতিবাচকভাবেই গ্রহণ করবেন এ কথা জোর দিয়েই বলা যায়।

‘বারান‘-এর সিনেমাটোগ্রাফি এবং ‘মিজ অ্যাঁ সিন‘ গুলো এককথায় চমৎকার।ইতালির বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক ফেদেরিকো ফেলেনির মতে, মহৎ চলচ্চিত্রকারের সৃষ্টিকর্ম তাঁর সিনেমাটোগ্রাফি দ্বারাই প্রমাণিত হয়।মাজিদ মাজিদি এ জায়গায় ছিলেন স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। সিনেমার কোনো দৃশ্যে কোথাও লতিফ এবং বারানকে একই শটে দেখা যায়নি তবুও সহজাত ও স্বতঃস্ফূর্ত চলচ্চিত্রায়নের কারণে দুজনের মাঝে বিদ্যমান ঘনিষ্ঠতা কিংবা একে অন্যের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বুঝতে দর্শকদের এতোটুকু অসুবিধা হবে না।
মাজিদি চিত্রনাট্যের প্রয়োজনে বিভিন্ন ধরনের লোকেশন ব্যবহার করেছেন বিশেষত: নির্মাণাধীন সাইটটির কথা বলা যায়। ৯৭ সেকেন্ডের ‘ক্রেন শটটির‘ কথা উল্লেখ না করলেই নয় যেখানে সুলতান ও রহমতের (বারান) নির্মাণাধীন সাইটটিতে প্রথমবার আগমন ঘটে। সেই ক্রেন শটের মাধ্যমে ক্যামেরা পরবর্তীতে পুরো সাইটটির তিনটি ভিন্ন তলায় অনুসরণ করে নির্মাণ কাজের ঠিকাদার মেমারের কাছে সুলতান ও রহমতকে নিয়ে যায়।পুরো শটটি দর্শকদের এক নজরে নির্মাণাধীন সাইটটি পরিচয় করিয়ে দিতে সমর্থ হয়।
কাব্যিক ও দার্শনিক বর্ণনাশৈলী
ইরান বরাবরই শিল্প–সাহিত্য,কাব্য, দর্শন ও দৃশ্যকাব্য চর্চার পীঠস্থান হিসেবে পরিগণিত হয়ে আসছে। মাজিদ মাজিদি ‘বারান‘ সিনেমায় বর্ণনাশৈলিতে রেখেছেন তার সুস্পষ্ট ছাপ।সিনেমার এক পর্যায়ে, প্রেয়সী বারানের অনুসন্ধানে ব্যস্ত লতিফের সাথে এক আফগান মুচির দেখা হয়।
মুচিটি লতিফের আকুল মনের অবস্থা বুঝতে পেরেই হয়ত কাব্যিক বাক্যে তুলে ধরে জীবনের বিরহী ভাষ্য :
তপ্ত বিরহী আগুন থেকে উৎপন্ন শিখাতেই দগ্ধ হয়ে যায় হৃদয়।
দূর থেকে প্রিয় মানুষটির ‘একটুকু ছোঁয়া লাগে, একটুকু কথা শুনি‘-ই ছিল মূলত লতিফের ভালোবাসার সংজ্ঞায়িত রূপ। সেই রূপে লতিফ কখনও নিজের মত করে পরিপূর্ণ, কখনও আবার ‘বহুল‘ একা।
আর তাই আফগান মুচির জবানে সিনেমার দার্শনিক সংলাপটিকে প্রায়শই সত্য মনে হবে দর্শকদের:
‘একাকি মানুষ সৃষ্টিকর্তার প্রতিবেশী।‘
‘বারান‘ সিনেমাটি কেন দেখা যায়?
তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়ন ও উৎকর্ষতার একবিংশ শতাব্দীতে সবকিছুর মতো প্রেম–ভালোবাসার নিদর্শনও বদলেছে। ভালোবাসার প্রতিজ্ঞা,প্রতিশ্রুতি, চাওয়া–পাওয়া, আর্থিক ও দৈহিক বিনিময়ের প্রদর্শন হরহামেশাই পাওয়া যায় বাস্তব জীবন ও সেলুলয়েডের ফিতায়।
আরো পড়ুন : মালায়লাম সিনেমা: গল্প যেখানে মূল নায়ক
‘বারান‘ সিনেমাটি এক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী এক অব্যক্ত ভালোবাসার গল্প যেখানে প্রতিশ্রুতি নেই,প্রতিজ্ঞা নেই,নেই কোনও কামনা–বাসনা কিংবা আবদার পূরণের শর্ত।
এমন ভালোবাসা কি আদৌ সম্ভব?

ফার্সি ভাষায় ‘বারান‘ মানে ‘বৃষ্টি‘। কিশোরী বারান হলো সেই অকস্মাৎ বৃষ্টি যার অপ্রত্যাশিত আগমন প্রেমিক লতিফের চক্ষু শীতল করেছে এবং হৃদয়ে দোলা দিয়েছে ভালোবাসার নিরব গর্জনে।তো কতটুকু পরিপূর্ণতা পেয়েছিল এই কামনা–বাসনা,প্রত্যাশাহীন সেই ভালোবাসা?
একপাক্ষিক প্রচেষ্টা বা আত্মত্যাগই কি এর একমাত্র সমার্থক ছিল?নাকি এ ভালোবাসায় তৃপ্ত ছিল কিশোরী বারান এবং প্রেমিক লতিফ উভয়েই?প্রশ্নের উত্তরগুলো পেতে হলে দর্শকদের সিনেমাটি উপভোগ করতে হবে।
আইএমডিবি রেটিং: ৭.৮/১০
ব্যক্তিগত রেটিং :৮/১০
This is a Bengali article on a movie named Bararn.
Feature Image : Giffoni Film Festival
Source : Baran