ফাতেমীয় খিলাফত: ইসলামের একমাত্র শিয়া খিলাফত
ফাতেমীয় খিলাফত, ইসলামী খিলাফতগুলোর মধ্যে চতুর্থ এবং একমাত্র শিয়া খিলাফত। এই খিলাফত ইসমাইলি শিয়া মতবাদকে ধারণ করত। এই রাজবংশ আফ্রিকার ভূমধ্যসাগরীয় উপকূল শাসন করত এবং মিশরকে খিলাফতের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করে। সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছার পর ফাতেমীয় খিলাফতের অধীনে মাগরেব, সুদান, সিসিলি, লেভান্ট ও হেজাজ শাসিত হয়।
ফাতেমীয়দের দাবি অনুযায়ী তারা মুহাম্মদ এর কন্যা হযরত ফাতিমা (রাঃ) ও হয়রত আলী (রাঃ)-র বংশধর ছিল। তাদের মতে ৯০৯ খ্রিষ্টাব্দে উত্তর আফ্রিকায় ফাতেমি বংশের প্রতিষ্ঠাতা ওবায়দুল্লাহ আল মাহদী হযরত আলী (রাঃ) ও হযরত ফাতেমা (রাঃ) বংশের ষষ্ঠ ইমাম জাফর সাদিকের পুত্র ইসমাঈলের বংশধর ছিলেন।

কারবালার মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পর মুসলিমদের সাথে হয়রত আলী (রাঃ)-এর বংশধরদের প্রতি সহানুভূতির সৃষ্টি হয়। কাজেই মুসলিম জাহান হযরত আলী (রাঃ) এর বংশধরদের পক্ষে নানান প্রচারণা শুরু করে। সেই সুবাধে আলী(রাঃ) এর বংশধরগণ উমাইয়া ও আব্বাসীয় খিলাফতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। তাদের বক্তব্য ছিল উমাইয়া ও আব্বাসীয়রা তাদেরকে অন্যায়ভাবে খিলাফত বঞ্চিত করেছে।
সময়ের বিবর্তনের সাথে ৯০৯ খ্রিষ্টাব্দে ওবায়দুল্লাহ আল মাহদী কর্তৃক ফাতেমীয় বংশের নামে নতুন খিলাফত প্রতিষ্ঠা করে। এ খেলাফতের প্রথম খলিফা হিসেবে ওবায়দুল্লাহ আল মাহদী ক্ষমতাসীন হন। খলিফা হিসেবে অভিসিক্ত হওয়ার পূর্বে তাঁর নাম ছিল সাঈদ বিন হোসেন। পিতা হোসেন মাসতুর ছিলেন ইসমাইলি শিয়াদের গদ্দিনশীন ‘ইমাম’।
পূর্বে লোহিত সাগর থেকে শুরু করে পশ্চিমে আটলান্টিক মহাসাগর পর্যন্ত উত্তর আফ্রিকার বিস্তীর্ণ এলাকায় এই খিলাফতের অধীনস্থ ছিল। তারা উত্তর আফ্রিকা জয় করে। কুতামা নামক বার্বার গোষ্ঠীর মধ্যে ফাতেমীয় রাষ্ট্র আকার লাভ করে। এ খিলাফত তিউনিসিয়াকে ভিত্তি করে গড়ে উঠে।
ওবায়দুল্লাহ আল মাহদী বাগদাদের আব্বাসীয় খিলাফতের প্রতিদ্বন্দ্বীরূপে উত্তর আফ্রিকা ও মিসরে শিয়া মতাদর্শীদের নিয়ে এ খিলাফত প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ছিলেন ফাতেমীয় খিলাফতের একজন যোগ্য শাসক। তিনি অত্যন্ত যোগ্যতার সাথে শাসনকার্য পরিচালনা করেন। ওবায়দুল্লাহ আল মাহদীই ফাতেমীয় খিলাফতের ভিত্তি স্থাপন করেন, যা পরবর্তীতে ১১৭১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত স্থায়ী হয়। এ খিলাফত ১৪ জন খলিফা কর্তৃক সুদীর্ঘ আড়াই শ বছরেরও অধিক সময় শাসন করে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করে।

ফাতেমীয় খিলাফতের সময়কালে জ্ঞান-বিজ্ঞান, স্থাপত্য, শিল্পকলা ও সংস্কৃতি চর্চায় অভূতপূর্ব উন্নতি সাধিত হয়েছিল, যা তৎকালীন বিশ্বে বিরল ছিল। ফাতেমীয় খলিফাগণ জ্ঞান-বিজ্ঞান, স্থাপত্য, শিল্পক্ষেত্রে উন্নতিকল্পে অত্যন্ত অনুরাগী ছিলেন। তাদের এই অনুরাগ জ্ঞান বিকিরণ ও দীর্ঘ আড়াইশ বছর শাসন করার পথটা সমুন্নত করেছিল। আর তা পরবর্তীকালে মুসলিম বিশ্ব, এমনকি ইউরোপীয় সভ্যতাকেও গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল।
কিন্তু ইতিহাসে উত্থান-পতন এক অমোঘ বিধান৷ ব্যতিক্রম ঘটেনি ফাতেমীয় খিলাফতের ক্ষেত্রেও। এত উন্নয়ন ও সুশাসনের পরও পতন ঘটেছিল ফাতেমীয় খিলাফত-এর। প্রথম শতক উর্ধগামী হলেও তৃতীয় শতক পেরুতে না পেরুতেই ফাতেমীয় খিলাফতের মুখ লুকাতে হয় ইতিহাসের পাতায়। এর নেপথ্যে ছিল পরবর্তী শাসকদের অদূরদর্শীতা ও অযোগ্যতা।
সেই সাথে শিয়া-সুন্নীর চরম বিরোধ, সামরিক কোন্দল এবং প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট দুর্ভিক্ষও দায়ী। এছাড়াও শিয়া-সুন্নী বিরোধের সুযোগ নিয়ে খ্রিস্টানদের প্রতি নির্যাতনের অজুহাতে ক্রুসেডরগণ বারবার হামলা করে ফাতেমীয়দের শক্তি খর্ব করে দেয়।
আরো পড়ুন : তাবুক যুদ্ধ : মহানবীর জীবনের শেষ যুদ্ধ (ভিডিও)
পরবর্তীতে একাদশ ও দ্বাদশ শতাব্দীতে ফাতেমীয় খিলাফতের পতন ঘটতে থাকে। ১১৭১ সালে সুলতান সালাহউদ্দিন ফাতেমীয় খিলাফতের সর্বশেষ শাসক খলিফা আল-আযীযকে সিংহাসনচ্যুত করে মিশর অধিকার করে নেন। তিনি আইয়ুবীয় রাজবংশের সূচনা করেন এবং একে বাগদাদের আব্বাসীয় খিলাফতের সাথে যুক্ত করেন। অতঃপর সমূলে পতন ঘটে ফাতেমীয় খিলাফতের।
This is a Bengali article about ‘the history of fatimid caliphate’.
Feature image source: dairy.com
Referrence: