ওয়ানডেতে বাংলাদেশ: আট পরাশক্তির বিপক্ষে প্রথম জয়ের গল্প
১৯৮৬ সালে প্রথম ওয়ানডে ম্যাচ খেললেও ওয়ানডেতে জয় পেতে বেশ কয়েক বছর লেগে গিয়েছে বাংলাদেশ দলের। ১৯৯৮ সালে প্রথম ওয়ানডে ম্যাচে জয় পেলেও তা ছিল দুর্বল শক্তির দল কেনিয়ার বিপক্ষে। তবে ক্রিকেট জগতের বড় বড় দৈত্যদের বধ করতেও এরপর খুব বেশি অপেক্ষা করতে হয়নি বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে।
চলুন জেনে আসা যাক ওয়ানডেতে ক্রিকেটের সেরা দেশগুলোর বিপক্ষে বাংলাদেশ দলের প্রথম জয়গুলো সম্পর্কে।
নিউজিল্যান্ড
অক্টোবর, ২০০৯। মিরপুরে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টাইগারদের ঐতিহাসিক জয়। কিউইদের বিপক্ষে প্রথমবার জেতার পাশাপাশি এই ম্যাচজয় উদযাপনের আরেকটি উপলক্ষ রয়েছে। কোচ জেমি সিডন্স এবং অধিনায়ক আশরাফুলের জন্য এটি প্রথম বড় কোনো জয়।
তখনকার সাম্প্রতিক সময়ে বেশ সমালোচনার মুখোমুখি ছিলেন কোচ-অধিনায়ক দুইজনই। এই জয় তাদের জন্য কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস বয়ে এনেছিল।

এই জয় আসলে কারও একার কৃতিত্ব ছিলো না। ছিল দলীয় পারফর্মেন্সের ফলে অভূতপূর্ব এক জয়। টসে হেরে ব্যাট করতে নামা কিউইদের প্রথম ধাক্কাটা দিয়েছিলেন মাশরাফি। ওপেনিংয়ে নামা ম্যাককালামকে আউট করে দিয়েছিলেন ১৪ রানেই। তারপর একে একে বোলিং যাদু দেখান স্পিনার আব্দুল রাজ্জাক, সাকিব আল হাসান এবং অভিষিক্ত নাঈম ইসলাম।
অপারেশনের পর দুই হাঁটুতে ব্রেস নিয়ে খেলতে নেমেও লাইন লেন্থে কোনো ভুল করেননি মাশরাফি। ম্যাচে উইকেট নিয়েছিলেন ৪টি। ৫০তম ওভারে ক্যাচ মিস না করলে সংখ্যাটা ৫ হতে পারতো। একটা সময় নিউজিল্যান্ড দলের সংগ্রহ ছিল ৬ উইকেটে ৭৯ রান। সেই ম্যাচে বাংলাদেশের একমাত্র ভুল ছিল এই স্কোরলাইন ২০০ পার হতে দেয়া। তবে ভুল খুব দ্রুতই শুধরে নেয় টাইগাররা।
জবাব দিতে নেমে ব্যাটসম্যানরা জ্বলে উঠেন কিউইদের বিপক্ষে। অধিনায়ক আশরাফুল করেন অপরাজিত ৬০ রান। তবে এই দিনের বড় তারকা ছিলেন জুনায়েদ সিদ্দিক। আগের ৮ ইনিংসে সর্বমোট ৬২ রান করা জুনায়েদ এই ম্যাচে করেন ৮৫ রান।
ম্যাচের ব্রেকে সাবেক অধিনায়ক খালেদ মাসুদ পাইলটকে ফেয়ারওয়েল দেন দুই দলের ক্রিকেটাররা। জুনায়েদ নিজের ৮৫ রানের ইনিংস উৎসর্গ করেন খালেদ মাসুদকে। আর ওয়ানডেতে বাংলাদেশ পায় নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে তাদের প্রথম জয়।
ভারত
সেদিন দেশে ছিল আধাবেলা হরতাল। সেই হরতালের তোয়াক্কা না করে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে জড়ো হয়েছিলো ৪৫ হাজার দর্শক। উদ্দেশ্য ছিলো ভারতের বিপক্ষে টাইগারদের সমর্থন দেয়া। ম্যাচটি ছিলো ওয়ানডেতে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের জন্য একটি মাইলফলক। ২০০৪ সালের ২৬শে ডিসেম্বরে ভারতের বিপক্ষে সেই ম্যাচটি ছিল বাংলাদেশ দলের ১০০তম ওয়ানডে ম্যাচ।

আগের ম্যাচে জয় পাওয়ায় দলে বড়সড় কিছু পরিবর্তন আনে ভারত। মাঠে নামেননি ভারতের চার মূল খেলোয়াড় শচীন টেন্ডুলকার, রাহুল দ্রাবিড়, হরভজন সিং এবং ইরফান পাঠান। এর আগে ভারতের সাথে তিনটি ওয়ানডেতেই হারের মুখ দেখেছিল বাংলাদেশ দল। তাই হয়ত তারা ভেবেছিলো বাংলাদেশকে হারাতে কি আর এই খেলোয়াড়দের প্রয়োজন হবে নাকি! তবে তাদের ধারণা ভুল প্রমাণ করে দিয়েছিল টাইগাররা।
খেলার শুরুটা খুব আহামরি ছিলো না। আগের ম্যাচগুলোর মতোই দ্রুত উইকেট হারাচ্ছিলো বাংলাদেশ। তখন মাঠে বাংলাদেশের খেলার ধাঁচ ছিল প্রায় একই। রান শতক পার হওয়ার আগেই কিছু উইকেট পড়ে যাবে। তারপর দলের লক্ষ্য থাকবে যাতে কোনোরকম পঞ্চাশতম ওভার পর্যন্ত টিকে থাকা যায়। এবারও মোটামুটি সেদিকেই আগাচ্ছিল খেলা।
কিন্তু নিজের ক্যারিয়ারের সপ্তম ম্যাচে সেই পথে হাঁটতে হয়ত নারাজ ছিলেন নবীন ব্যাটসম্যান আফতাব আহমেদ। ৯৮ বল খেলে রান করলেন ৬৭। আফতাব যখন কার্তিকের বলে মাঠ ছাড়ছেন, তখন স্কোরবোর্ডে রান ১৬৮। ভারত দলের কাছে তখনও সুযোগ ছিল ২০০ রানের আগেই বাংলাদেশকে আটকে ফেলার।
কিন্তু ১৫ মাস পরে দলে ফেরা পেসার মাশরাফি তা হতে দেন কি করে? নবম উইকেটে নেমে করলেন ৩১ রান। তার আর তাপস বৈশ্যর জুটিতে বাংলাদেশ করে ২২৬ রান। শেষমেশ ২৩০ রানের টার্গেট দেয় বাংলাদেশ দল।
ব্যাটিংয়ে যেরকম দলের হাল ধরেছিলেন, তেমনি বোলিংয়ে নেমেও স্টেডিয়ামের দর্শকদের হতাশ করেননি মাশরাফি এবং তাপস বৈশ্য। পুরো ম্যাচে নিজেদের লাইন লেংথ ঠিক রেখে নাকানিচুবানি খাইয়ে গেছেন ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের। শেষে ২১৪ রান করেই সন্তুষ্ট থাকতে হয় ভারতের। হাবিবুল বাশারের নেতৃত্বে প্রথমবারের মতো সৌরভ গাঙ্গুলীর ভারতকে হারালো বাংলাদেশ দল।
অস্ট্রেলিয়া
২০০৫ সালের জুন মাস। ন্যাটওয়েস্ট সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচ ছিল অস্ট্রেলিয়া বনাম বাংলাদেশের। ভেন্যু ছিলো ইংল্যান্ডের কার্ডিফের সোফিয়া গ্রাউন্ডস। ক্রিকেট পরাশক্তি অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে বাংলাদেশের খুব একটা সুযোগ ছিল না। থাকবে কী করে? অস্ট্রেলিয়া দলে তখন খেলতেন ম্যাথু হেইডেন, অ্যাডাম গিলক্রিস্ট, রিকি পন্টিং, মাইক হাসি, ক্লার্কদের মতো বাঘা বাঘা সব খেলোয়াড়।
এই মাঠ কাঁপানো ব্যাটসম্যানদের থামানোর দায়িত্ব ছিল রফিক, মাশরাফি, তাপস বৈশ্যদের কাঁধে। আর উল্টোদিকে জাভেদ ওমর, নাফিস ইকবাল, আশরাফুল, হাবিবুল বাশারদের প্রতিপক্ষ ছিলেন গ্লেন ম্যাকগ্রাথ, জ্যাক গিলেস্পিদের মতো বোলাররা। বাংলাদেশ দলের বোলিং বা ব্যাটিং লাইন আপ কারো জন্যই তাদের প্রতিপক্ষকে সামাল দেয়া খুব সহজ কাজ ছিলো না।

সবাইকে স্তব্ধ করে দিয়ে সেই ম্যাচে নতুন এক ইতিহাস তৈরি করে ফেললেন বাংলাদেশের নবীন সেই ক্রিকেটাররা। টসে জিতে অজিদের হয়ে ব্যাটিং শুরু করেন অ্যাডাম গিলক্রিস্ট এবং ম্যাথু হেইডেন। কার্ডিফের দর্শকদের হতভম্ব করে দিয়ে মাত্র দ্বিতীয় বলেই মাশরাফির হাতে বধ হন গিলক্রিস্ট। বিস্ময়ের তখন মাত্র শুরু। গিলক্রিস্টের সাজঘরে ফেরার পর ব্যাট হাতে নামেন পন্টিং। তিনিও ১৬টি বল খেলে মাত্র এক রান সংগ্রহ করে মাঠ ছাড়েন।
সেরা ব্যাটিং লাইনআপ সামলানোর দায়িত্ব খুব ভালোভাবে পালন করেন মাশরাফি-তাপস বৈশ্যরা। তবে অবাক করার মতো পারফর্মেন্স দিয়েছিলেন মোহাম্মদ রফিক। দশ ওভারে অজিদের দিয়েছেন মাত্র ৩১ রান। ইনিংস শেষে আড়াইশ রানের টার্গেট তাড়া করতে নামেন বাংলাদেশী ব্যাটসম্যানরা।

বোলারদের মতো ব্যাটসম্যানদের শুরুটা অত ভালো ছিলো না। ৭২ রানে ৩ উইকেট হারানোর পর মনে হচ্ছিল বুঝি সবসময়ের মতো আবারও হারতে হবে অস্ট্রেলিয়ার কাছে। কিন্তু গেম চেঞ্জার হিসেবে মাঠে নেমেছিলেন আশরাফুল। সেঞ্চুরি করে খেলায় ফেরান দলকে। অধিনায়ক হাবিবুল বাশারের সাথে জুটি গড়ে রানের খাতায় যোগ করেন ১৩০ রান। কিন্তু শতক তুলেই আউট হয়ে যান আশরাফুল।
শেষ ওভারে দরকার ছিলো ৭ রান। সিঙ্গেল নিয়ে ম্যাচ জেতার কথাই সবার মাথায় আসবে এরকম পরিস্থিতিতে। না,সবার মাথায় না। অল্পবয়সী আফতাবের মাথায় অন্যকিছু ঘুরছিলো। গিলেস্পির প্রথম বলটিই তার মাথার উপর উড়িয়ে মেরে পাঠিয়ে দিলেন মাঠের বাইরে। পরের বলে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। সিঙ্গেল নিয়ে ম্যাচ জিতলেন আফতাব। সেই সঙ্গে লিখা হলো অস্ট্রেলিয়া-বধ কাব্য।
ইংল্যান্ড
ইংল্যান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশের জয়টা খুব বেশিদিন আগের নয়। ২০১০ সালের জুলাইয়ে ব্রিস্টলে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেই জয়টা ছিলো ক্রিকেটের সবধরনের ফরম্যাটে বাংলাদেশের প্রথম জয়।

ম্যাচ শুরুর আগেও বাংলাদেশ দলের অবস্থা খুব একটা সুবিধার ছিল না। দলের মূল দুই খেলোয়াড় রকিবুল হাসান এবং উইকেটকিপার মুশফিকুর রহিম ছিলেন না দলে। বদলি হিসেবে আসা মোহাম্মদ আশরাফুল ম্যাচ শুরুর মাত্র ১৪ ঘন্টা আগে এসে পৌঁছেছিলেন ইংল্যান্ডে। তার উপর আগের ২৪টি ম্যাচ হারার কারণে স্বাভাবিকভাবেই দলের উপর চাপ ছিল একটু বেশি।

ব্যাটিংয়ে নেমে খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি বাংলাদেশ দল। ইমরুল কায়েস(৭৬) এবং জহুরুল ইসলাম(৪০) বাদে দলের কেউই ২০-২২ রানের বেশি রান করতে পারেননি। ব্যাটসম্যানদের নড়বড়ে পারফর্মেন্সের পর ম্যাচ জেতানোর গুরুদায়িত্ব নিজেদের কাঁধে নিয়ে নেন বাংলাদেশ দলের বোলাররা। নেতৃত্ব দেন রুবেল হোসেন এবং আব্দুল রাজ্জাক। ইংল্যান্ড দলের ব্যাটিং লাইনআপের টপ অর্ডারের চারজন ব্যাটসম্যানকে থিতু হওয়ার আগেই মাঠ ছাড়া করেন এই দুই বোলার। তবে হুমকি দাঁড়িয়েছিলেন জনাথন ট্রট।
স্টুয়ার্ট ব্রডের সাথে জুটি করে দলকে প্রায় সামলে ফেলছিলেন। কিন্তু আবারও বাঁধ সাধে টাইগারদের বোলার গ্রুপ। এবার পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়ান মাশরাফি বিন মর্তুজা। ৪৭তম ওভারে ট্রটকে বিদায় করে সেই ওভারে মাত্র তিন রান দেন বাংলাদেশ দলের সাবেক এই অধিনায়ক। এত চেষ্টা করেও শেষ রক্ষা হয়নি থ্রি-লায়ন্স দলের। মাশরাফির সেই ওভারটিই ম্যাচ ঘুরিয়ে দেয়। বাংলাদেশ দলের করা ২৩৬ রানের জবাবে ২৩১ রান করে হারের মুখ দেখে ইংল্যান্ড দল। আর বাংলাদেশ অর্জন করে প্রথমবারের মতো ইংল্যান্ডকে হারানোর গৌরব।
পাকিস্তান
পাকিস্তানের সাথে জয়টা এসেছিল ১৯৯৯ বিশ্বকাপে। সেবার টুর্নামেন্টে প্রথমবারের মতো খেলতে গিয়েছিল টাইগাররা। অন্যদিকে পাকিস্তান ছিলো অন্যতম ফেভারিট। তুমুল ফর্মে ছিল তারা। স্কটল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজ এমনকি অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডকেও হারিয়েছে বেশ ভালোভাবেই। আর অভিষিক্ত বাংলাদেশ তখন পর্যন্ত ২০০ রানও করতে পারেনি কোনো ম্যাচে। পুঁচকে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষেও না।
তবে উড়তে থাকা পাকিস্তানকে সেবার টেনে মাটিতে নামিয়ে দিয়েছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। ইংল্যান্ডের নর্দাম্পটন এর কাউন্টি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে সেবার বাংলাদেশ দল মাঠে নেমেছিল আমিনুল ইসলামের নেতৃত্বে। পাকিস্তানের অধিনায়ক ছিলেন ওয়াসিম আকরাম। সাথে দলে ছিলেন সেলিম মালিক, সাকলায়েন মোশতাক, শোয়েব আখতারের মতো নামভারী খেলোয়াড়েরা।
বাংলাদেশ দলে ছিলেন নাইমুর রহমান দুর্জয়, খালেদ মাহমুদ সুজন, খালেদ মাসুদ পাইলট, মোহাম্মদ রফিকসহ আরও অনেকে।

ব্যাটিংয়ে নেমে বাংলাদেশ দলকে সামলাতে হয় সাকলায়েন মোশতাকের স্পিন আর সাথে শোয়েব আখতারের তুমুল গতির বল। পাকিস্তানের বোলিং তোপ ঠিকই সামলিয়ে বাংলাদেশ দল তুলে নেয় ২২৩ রান। পাকিস্তানের মারকুটে ব্যাটিং লাইনআপ তখন। মনে হচ্ছিল হয়ত ২-৩ উইকেটেই এই টার্গেট পূরণ করে ফেলবে পাকিস্তান দল। কিন্তু বাংলাদেশের বোলাররা পাকিস্তানের সাথে লড়াইটা ব্যাক্তিগত লড়াইই বানিয়ে ফেললেন, বিশেষ করে খালেদ মাহমুদ সুজন(বর্তমান বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের ম্যানেজার)।
কোথায় তাদের আশা ছিল বাংলাদেশকে তুলোধুনা করবে, বরং ৭ উইকেট হারিয়ে পাকিস্তান দলের সংগ্রহ তখন ১১৬। অবশেষে এলো সেই মুহূর্ত। ব্যাটিংয়ে পাকিস্তানের শেষ ভরসা ছিলো সাকলায়েন মোশতাক এবং শোয়েব আখতার। ৪৪তম ওভারে নাইমুর রহমান দুর্জয়ের দ্বিতীয় বলেই কিপার খালেদ মাসুদের নৈপুণ্যে রান আউট হন সাকলায়েন।
মাত্র ১৬১ রানেই গুটিয়ে যায় শক্তিশালী পাকিস্তান দল। প্রথমবারের মতো পাকিস্তান ক্রিকেট দলকে হারায় টাইগাররা। সেটি ছিল বিশ্বকাপে টাইগারদের দ্বিতীয় জয়। প্রতিপক্ষ পাকিস্তান হওয়ায় জয়টা একটু বেশিই মহিমান্বিত।
দক্ষিণ আফ্রিকা
দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে বাংলাদেশের জয়টা একটু বেশিই জ্বলজ্বলে হয়ে থাকবে বাংলাদেশ ক্রিকেটের ইতিহাসে। কারণ দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টাইগারদের প্রথম জয়টা এসেছিল বিশ্বকাপে। ২০০৭ আইসিসি বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারায় বাংলাদেশ দল।

র্যাঙ্কিংয়ে এক নম্বরে ছিলো প্রোটিয়ারা। তাদের দলে ছিলে গ্রায়েম স্মিথ, এবি ডি ভিলিয়ার্স, জ্যাক ক্যালিস, শন পোলোকদের মতো খেলোয়াড়। অন্যদিকে প্রতিপক্ষ বাংলাদেশ দল তখন র্যাঙ্কিংয়ে ছিলো ৯ নম্বরে। আগের সাত সাক্ষাতে বাংলাদেশ দল ২০০ এর কোটা পার করেছে মাত্র একবার। প্রোটিয়াদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ দলের সবচেয়ে ভালো রেকর্ড ছিলো ৮৩ রানে দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে হারা।
দলের অধিনায়ক হাবিবুল বাশারকে প্রশ্ন করা হয়েছিল এই ম্যাচে তাদের লক্ষ্য কী। অধিনায়ক জবাব দিয়েছিলেন তারা লড়াই করতে চান। বাস্তবিকভাবেই সেই ম্যাচে জান দিয়ে লড়েছিল টাইগাররা।

দক্ষিণ আফ্রিকা টসে জিতে ফিল্ডিংয়ের সিদ্ধান্ত নেয়। মোহাম্মদ আশরাফুলের ৮৭, সাথে তামিম ইকবাল, আফতাব আহমেদ, মাশরাফিরা মিলে ২৫২ রানের টার্গেট দেয় প্রোটিয়াদের। ব্যাটিংয়ে নেমে বাংলাদেশের বোলিং তোপের সামনে পড়ে দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটসম্যানরা। বিশ ওভার শেষে তিন উইকেট হারিয়ে তাদের সংগ্রহ ছিল মাত্র ৬৯ রান। ২৫ ওভার শেষে তা পৌঁছায় মাত্র ৯২ রানে। ম্যাচ শুরুর আগে প্রোটিয়া অধিনায়ক স্মিথ কখনো কল্পনাও করতে পারেননি যে তার অধিনায়ক জীবনের বাজে এক ম্যাচের সম্মুখীন হতে যাচ্ছেন তিনি।
অনায়াসেই ৪০০ রান পার করা দক্ষিণ আফ্রিকা দল সেবার ২০০ রানও সংগ্রহ করতে পারেনি। ১৮৪ রানেই সব উইকেটের পতন ঘটিয়ে বাংলাদেশ দল তাদের প্রথম জয় সংগ্রহ করে। সেই ম্যাচে টাইগাররা প্রমাণ করে দিয়েছিল র্যাঙ্কিং দেখে আসলে কোনো দলের ক্ষমতা যাচাই করা উচিত নয়।
শ্রীলঙ্কা
শ্রীলঙ্কার সাথে প্রথম জয়ের ঘটনা ২০০৬ সালে। বগুড়ার শহীদ চান্দু স্টেডিয়ামে। লঙ্কানদের বিপক্ষে এর আগে ১৫টি ওয়ানডে ম্যাচ খেলেছিল টাইগাররা। এটি ছিল ১৬তম ওয়ানডে। ম্যাচটি ছিলো বাংলাদেশ দলের কিংবদন্তি উইকেটকিপার খালেদ মাসুদের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচ।
টসে জিতে ফিল্ডিংয়ের সিদ্ধান্ত নেন বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক হাবিবুল বাশার। বোলারদের উপর ভরসা রেখেছিলেন তিনি। সেই ভরসার প্রতিদানও দিয়েছে বোলাররা। প্রথম ১১ ওভারে শ্রীলঙ্কার সংগ্রহ ছিল মাত্র ১৯ রান। তবে ভয় ধরিয়ে দিয়েছিলেন সনাথ জয়সুরিয়া। তার ৯৬ রানের ইনিংসেই অনেকটা এগিয়ে যায় শ্রীলঙ্কা দল। ৪৯ ওভার শেষে ২১২ রানে অল আউট হয়ে যায় লঙ্কানরা।

সেই ম্যাচে জ্বলে উঠেছিলেন আফতাব আহমেদ। বল হাতে ৬ ওভারে রান দিয়েছিলেন মাত্র ২৪। ব্যাট হাতেও খেলেছেন ২১ বলে ৩২ রানের দুর্দান্ত ইনিংস। আফতাব, জাভেদ ওমর, অধিনায়ক হাবিবুল বাশার, সাথে অর্ধশতক রান সংগ্রহ করা আশরাফুলের ব্যাটে সওয়ার হয়ে ৪৭ ওভারেই লঙ্কানদের দেয়া ২১৩ রানে টার্গেটে পৌঁছে গিয়ে বগুড়ার শহীদ চান্দু স্টেডিয়ামের ৩০,০০০ দর্শককে আনন্দে ভাসিয়ে প্রথমবারের মতো শ্রীলঙ্কা দলকে হারানোর স্বাদ পায় টাইগাররা।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ
২০০৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ট্যুরে গিয়েছিল বাংলাদেশ দল। দুই ম্যাচ টেস্ট সিরিজে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারানোর পর ওয়ানডে ম্যাচে নামে বাংলাদেশ দল। সেখানেও ক্যারিবিয়ানদের মাটিতেই তাদেরকে হারায় টাইগাররা। শুধু ওয়ানডে ম্যাচই না, সেই ওয়ানডে সিরিজে বাংলাদেশ দল জিতেছিল ৩-০ ব্যবধানে। ওয়ানডেতে বাংলাদেশের জয়টি ছিল বিদেশের মাটিতে প্রথম কোনো টেস্ট খেলুড়ে দলের বিপক্ষে জয়।

ডমিনিকাতে বাংলাদেশ দলের জয়ের কারিগর ছিলেন বাংলাদেশ দলের অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান। এই সাকিব তখনও বিশ্বসেরা হয়ে উঠেননি। কিন্তু মাঠে তার পারফর্মেন্স ঠিকই ইঙ্গিত দিচ্ছিল যে এক নবাব পেতে যাচ্ছি আমরা। নিজের অলরাউন্ড পারফর্মেন্সের শুরুটা হয় প্রথম ইনিংসে।
ব্যাটিংয়ে নেমে অর্ধশতক পূর্ণ করেন সাকিব। আশরাফুলের ব্যাট থেকেও আসে ৫৭ রান। প্রথম ইনিংস শেষে ৫০ ওভারে বাংলাদেশ দলের সংগ্রহ ছিলো ২৪৬ রান।

বোলিংয়ে ক্যারিবিয়ান ব্যাটসম্যানদের নাভিশ্বাস তুলে দেন সাকিব আল হাসান এবং আব্দুল রাজ্জাক। ব্যাটিংয়ে হুমকির ইঙ্গিত দেয়া ডেভন স্মিথকে বিদায় করে দেন আব্দুল রাজ্জাক। ডেভন স্মিথসহ মোট উইকেট সংগ্রহ করেন চারটি। এক উইকেট পাওয়া সাকিব রান দিতে বেশ কিপ্টেমি করেছেন ম্যাচটিতে। ৮ ওভারে দিয়েছিলেন মাত্র ২৬ রান।
আরো পড়ুন : মুমিনুল হক : সাইকেল চালিয়ে উচ্চতা বাড়ানো থেকে টেস্ট স্পেশালিস্ট হয়ে ওঠা
বাংলাদেশের বোলিং যাদুতে রানের খাতায় ২০০ হওয়ার আগেই অল আউট হয়ে যায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল। আর প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ দল হারায় ওয়েস্ট ইন্ডিজকে।
This is a Bangla article about Bangladesh national cricket team’s first ever ODI win against giant teams.
References:
- Bangladesh seal historic victory
- টাইগারদের দৈত্য বধের গল্প
- Tigers from underdogs
- Fans take to the streets
- Proof of Bangladesh’s ability
- Bangladesh bring the Super Eights to life