ইয়োহান ক্রুইফ: বার্সায় আধুনিক ফুটবলকে নতুনভাবে জন্ম দেয়া এক বিপ্লবী
ফুটবল সম্পর্কে ধারণা আছে, আর ইয়োহান ক্রুইফ কে চেনেন না এমন মানুষ বোধহয় খুঁজে পাওয়া ভার। চলুন আজ এই কিংবদন্তীর গল্পটাই জানার চেষ্টা করি এই লেখায়।
এপ্রিল ২৮, ১৯৮৮। ঘড়িতে বাজে সাতটা। বার্সেলোনা শহরের উত্তরদিককার রাস্তা কারের দেল ভাগোসের রাস্তার হোটেল হেস্পেরিয়া তখন আওয়াজে সরগরম। ক্যাম্প ন্যু থেকে মাত্র পাঁচ মিনিটের পথ।
মিটিং রুমে কনফারেন্স টেবিলে বসে আছেন ২১ জন বার্সেলোনা খেলোয়াড়, সাথে দলের প্রধান কোচ লুইস আরাগোনেস। “প্রেসিডেন্ট জোসেপ লুইস নুনেজ সাধারণ জনগণ হিসেবে আমাদের সাথে প্রতারণা করেছেন এবং পেশাদার হিসেবে আমাদের অপমান করেছেন,” অধিনায়ক আলেজানকো তার বিবৃতি পড়েন, “পরিশেষে, যদিও এই অধিকার শুধুমাত্র ক্লাব মেম্বাররা রাখেন, আমাদের খেলোয়াড়েরা চায় প্রেসিডেন্ট এই মুহূর্তে পদত্যাগ করুক।“

এই ঘোষণা ছিলো ক্লাব ম্যানেজমেন্টের জন্য একটা ধাক্কার মতো। “নুনেজ এই ক্লাবের মর্ম বুঝেন না, ভক্তদেরও তিনি ভালোবাসেন না,” মিডফিল্ডার ভিক্টর মুনেজ যোগ করেন, “তিনি শুধু নিজেকে ভালোবাসেন।“। ক্লাবে তখন একরকম গৃহযুদ্ধ চলছে, টাকা নিয়ে। স্প্যানিশ কর্তৃপক্ষ ক্লাবের খেলোয়াড়দের কন্ট্রাক্ট নিয়ে তদন্ত করে তাতে অসংগতি খুঁজে পায়। বলা হচ্ছিল যে খেলোয়াড়েরা ট্যাক্স ফাঁকি দিয়েছেন। খেলোয়াড়েরা যখন সরল বিশ্বাসে নিজেদের সমস্যা নিয়ে ক্লাব ম্যানেজমেন্টের কাছে যায়, তখন ক্লাব কর্তৃপক্ষ পুরো দায় তুলে দেয় খেলোয়াড়দের ঘাড়ে। স্বাভাবিকভাবেই ক্লাব প্রেসিডেন্টের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে খেলোয়াড়েরা।
‘হেস্পেরিয়া মিউটিনি’ নামে খ্যাত এই ঘটনাটি ছিল ১৯৪১/৪২ মৌসুমের পর বার্সেলোনার ইতিহাসের জঘন্যতম অবস্থা। হতাশায় ভোগা কোচ আরাগোনেস সেই মৌসুম শেষে ক্লাব ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ১৯৮৬ এর ইউরোপিয়ান কাপ ফাইনালিস্ট থেকে ফুটবল ক্লাব বার্সেলোনা মাত্র দুই বছরে পরিণত হয়েছিল সবার হাসির পাত্রে। পরিস্থিতি সামাল দিতে এবং আসন্ন নির্বাচনে নিজের জয় নিশ্চিত করতে নুনেজ খেললেন তার তুরুপের তাসটি।

ছয়দিন পর ১৯৮৮ সালের ৪ঠা মে বার্সেলোনার কোচ হিসেবে নাম ঘোষণা করা হলো বার্সা কিংবদন্তি ইয়োহান ক্রুইফ এর। তার বার্সায় আসার আগে বার্সা ১৪ বছরে জিতেছিল কেবল একটি লিগ শিরোপা। আট বছর পর, যখন এই বার্সা কিংবদন্তি বার্সার ডাগআউট ছাড়েন, বার্সার ট্রফি ক্যাবিনেটে তখন যুক্ত হয়েছে আটটি ট্রফি। নিজের সময়কার সেরা এই টোটাল ফুটবলার ১৯৭০ এর দশকে বার্সাকে বিপদের হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন খেলার মাঠে খেলোয়াড় হিসেবে নেমে। এক দশক পর আবার তিনি ফিরে এলেন নিজের পুরাতন ক্লাবকে ভরাডুবির হাত থেকে বাঁচাতে। তবে এবার খেলোয়াড় হিসেবে নয়, এবার তিনি বার্সার ত্রাতা হয়ে এসেছেন কোচ হিসেবে। অনেক বার্সা ভক্তের মতে তার সময়ে গড়া ড্রিম টিমই হলো বার্সেলোনা ইতিহাসের সর্বকালের সেরা দল।
হেস্পেরিয়া-পরবর্তী সময়ে এসেই দলকে পুনর্গঠনের কাজে লেগে পড়লেন ক্রুইফ। ১৫ জন খেলোয়াড়কে বিক্রি করে দেয়া হলো। তার মধ্যে মূল দলের ভিক্টর মুনোজ, রামোন কালদেরে এবং বার্নড শুস্টারও ছিলেন। তাদের জায়গা পূরণ করতে দলে আনা হলো ১২ জন খেলোয়াড়কে। যার মধ্যে উইঙ্গার জিকি বেগেরিস্টাইন, এটাকিং মিডফিল্ডার হোসে মারি বাকেরো, সেন্টার ফরওয়ার্ড হুলিও সালিনাস এবং ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার ইউসেবিও হয়ে উঠেছিলেন ক্রুইফের ড্রিম টিমের অবিচ্ছেদ্য খুঁটি।

নুনেজের আপত্তি সত্ত্বেও, মিউনিটির ডাক দেয়া আলেজাঙ্কোকে দলে রেখেছিলেন ইয়োহান ক্রুইফ। প্রি-সিজনে প্রেজেন্টেশনে আলেজাঙ্কো ক্লাবের ভক্তদের কটুক্তির শিকার হলে এর প্রতিবাদ করেন ইয়োহান ক্রুইফ। “আলেজাঙ্কো কেবল অধিনায়ক হিসেবে নিজের দায়িত্ব পালন করেছে, আর কিছুই না,” ক্রুইফ বলেন, “সে ছিল তার দলের প্রতিনিধি। নিজের দলকে হতাশ করেনি সে। এটা একটা গুণ। প্রায়ই বার্তাবাহক মারা যায়। আমার সাথে তা হবে না। যদিও নিয়মিত নয়, কিন্তু সে একজন নেতা। তাদের মধ্যে ঐক্য ছিলো।“ স্বাভাবিকভাবেই দলে হস্তক্ষেপ করতে চেয়েছিলেন নুনেজ। “আপনি জাহান্নামে যান, মি. প্রেসিডেন্ট। এখানে আধিপত্য আমার,” ক্রুইফ প্রেসিডেন্টকে বলেন, “আপনি যদি আমার সাথে কথা বলতে চান, আমি আপনার অফিসে আসবো। আপনি আমার ড্রেসিংরুমে আসবেন না।“
আবারও দল গঠনে মনোযোগ দিলেন ইয়োহান ক্রুইফ। ১৯৮৮ সালের জুলাই মাসের প্রথম দিকে দলের খেলোয়াড়দের নিয়ে প্রথমবারের মত মিটিংয়ে বসলেন তিনি।

“একটা ব্ল্যাকবোর্ড বের করে তিনি তাতে আঁকলেন তিনজন ডিফেন্ডার, চারজন মিডফিল্ডার, দুইজন আউট-এন্ড-আউট উইঙ্গার এবং একজন ফরওয়ার্ড।“ স্মৃতির পাতা থেকে ইউসেবিও বলেন, “আমরা একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম, “এটা আবার কি?”। সেই যুগটা ছিল ৪-৪-২ কিংবা ৩-৫-২ এর। দলে এত অ্যাটাকার ছিলো, কিন্তু ডিফেন্ডার ছিল এত কম- এই ব্যাপারটা আমরা মানতে পারছিলাম না। তিনি নিজ হাতে স্পেনে ফুটবল খেলার এক নতুন তরিকা বের করলেন। এটা ছিল একটা বিপ্লব।“ ১৯৭০ এর দশকে আয়াক্স এবং নেদারল্যান্ডে রাইনাস মিশেলসের অধীনে ক্রুইফ যে ৪-৩-৩ ফর্মেশনে খেলতেন, এই ৩-৪-৩ ছিল তারই একটা রূপ।
“দুইজন অ্যাটাকারকে থামাতে যদি আপনার চারজন ডিফেন্ডারের প্রয়োজন হয়, তাহলে দলের বাকি আটজনের বিপক্ষে মিডফিল্ডে থাকে মাত্র ছয়জন। এই অবস্থায় যুদ্ধে জয়লাভ করা কোনোভাবেই সম্ভব না। একজন ডিফেন্ডারকে আমাদের সামনে রাখতে হয়েছিল।“ ক্রুইফ পরে ব্যাখ্যা করেন।

যাই হোক, এই সিস্টেমে খেলোয়াড়রা মাঠে নিজেদের স্বাধীনতা বেশ উপভোগ করতেন। “৩-৪-৩ আমার বেশ ভালো লাগতো,” ক্রুইফের অধীনে ২৫০ ম্যাচ খেলা ইউসেবিও বলেন, “আমি অন্য সিস্টেমে খাপ খাওয়াতে যত কষ্ট করেছি, বার্সায় অতটা করিনি।“
আরো পড়ুন : লিওনেল মেসি আর বার্সেলোনার আসল রহস্য
ক্রুইফের সিস্টেমের মূলমন্ত্র ছিল বলের পজিশন ধরে রাখা, যা এখনও বার্সেলোনার খেলার ট্রেডমার্ক। “এটা বেসিক কনসেপ্টঃ যখন আপনি বল নিজের দখলে রাখেন, আপনি দ্রুত আগাতে পারবেন,” ক্রুইফ বলেন, “আপনার কাছে যা আছে প্রতিপক্ষের কাছে তা নেই, এজন্য তারা গোল করতে পারবে না। বল যার পায়ে থাকবে সে-ই সিদ্ধান্ত নিবে যে বল কোনদিক আগাবে। এবং আপনি যদি দ্রুত আগান, প্রতিপক্ষকে নিজের সুবিধামতো খাটিয়ে নিতে পারবেন। আপনি যেদিকে চাইবেন, বল সেইদিকেই যাবে।“

কিন্তু এই সিস্টেমের কিছু সমস্যা ছিল। ক্রুইফের পরিকল্পনা মাঠে বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন ছিল টেকনিকালি গিফটেড খেলোয়াড়ের। পজিশনের জন্য ক্ষুধার্ত প্রতিভাবান কিছু খেলোয়াড়ের দরকার ছিলো মাঠে। ফলস্বরূপ ঢেলে সাজানো হলো লা মাসিয়াকে।
ইয়োহান ক্রুইফ না থাকলে আজ লা মাসিয়া থেকে জাভি, ইনিয়েস্তা, মেসিদের পাওয়া যেতো না। ক্রুইফের আসার আগে লা মাসিয়াতে খেলোয়াড় নেওয়া হতো শারীরিক শক্তিমত্ততার ভিত্তিতে, টেকনিকালিটির উপর ভিত্তি করে নয়। যাদের উচ্চতা ৫’৯” এ পৌছানোর সম্ভাবনা থাকতো, শুধুমাত্র তারাই একাডেমিতে জায়গা পেত।
ক্রুইফের আগমনের পর পালটে গেলো দৃশ্যপট। “আমার দলে আলবার্ট ফেরার, সার্জি বা গুইলের্মো আরমোরের মতো খাটো খেলোয়াড়েরা ছিল। এই খেলোয়াড়দের শারীরিক গঠন খুব ভালো ছিলো না কিন্তু তারা বল সামলাতো অনেক যত্নের সাথে আর খুব ভালোভাবে প্রেস করতো প্রতিপক্ষকে। এমনকি পেপও (গার্দিওলা) শারীরিক দিক দিয়ে খুব শক্তিশালী ছিলো না কিন্তু বল পায়ে সে বেশ ভালো ছিলো। এটাই আমার দরকার ছিলো।“

ক্রুইফের অধীনে বার্সেলোনার অনূর্ধ্ব-৮ থেকে শুরু করে বার্সা বি পর্যন্ত সবাইকে প্রস্তুত করা হতো ক্রুইফের ৩-৪-৩ সিস্টেমে খাপ খাওয়ানোর জন্য। ফেরার, আমোর, সার্জিদের মতো লা মাসিয়া গ্র্যাজুয়েটরা ক্রুইফের অধীনে খেলেছিলেন ১০০০ এরও বেশি ম্যাচ। এরা কেউই ৫’৯” এর বেশি ছিলেন না। তাদের চেয়ে কিছুটা লম্বা গার্দিওলা খেলেছিলেন ৩৮৪ ম্যাচ।
বার্সায় ক্রুইফের পরিকল্পনা বেশ ভালোভাবেই আগাচ্ছিলো। কিন্তু সব প্রজেক্টেরই শুরুতেই কিছু না কিছু সমস্যা দেখা দেয়ই। এখানেও তাই হয়েছিল। ১৯৮৮/৮৯ মৌসুমে ইউরোপিয়ান কাপ উইনার্স কাপ এবং পরের মৌসুমে কোপা দেল রে জেতেন ইয়োহান ক্রুইফ। কিন্তু ১৯৮৯ এর গ্রীষ্মের গুরুত্বপূর্ণ দুই সাইনিং মিশেল লাউড্রপ এবং রোনাল্ড কোম্যান সেভাবে জ্বলে উঠতে পারছিলেন না। ক্রুইফও ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন নিজের সাইনিংকে ডিফেন্ড করতে করতে। প্রেস ব্রিফিং পারতপক্ষে এড়িয়ে চলতেন। ইন্টারভিউতে অংশগ্রহণ করতেন, কিন্তু তেমন কিছু জানাতেন না তাদের। এক রিপোর্টারকে তিনি বলেছিলেন, “আমি যদি তোমাকে বুঝতে দিতে চাইতাম, তাহলে আরও ভালোভাবে ব্যাখ্যা করতাম।“

১৯৯০ সালে মাদ্রিদের ১১ পয়েন্ট পিছনে থেকে লিগ শেষ করা ইয়োহান ক্রুইফ সেবার বেঁচে গিয়েছিলেন কোপা দেল রে জিতেছিলেন বলে। নুনেজ বার্সার ক্লাব মেম্বারদের ভেটো নিয়েছিলেন দেখার জন্য যে কারা এই ডাচম্যানের দায়িত্বে থাকার পক্ষে আছে।
কিন্তু পরের ১৯৯০/৯১ মৌসুমেই বার্সায় নতুন এক যুগের সূচনা হয়েছিল। ক্রুইফের গড়ে তোলা লা মাসিয়ার ফল এই মৌসুমে ধীরে ধীরে পাওয়া যাচ্ছিল।

১৯৯১/৯২ মৌসুমে কিছুটা ধীরগতিতেই শুরু করেছিলো বার্সেলোনা। প্রথম আট ম্যাচের মাত্র তিনটিতে হারা বার্সেলোনার টার্নিং পয়েন্ট এলো সেই বছরের নভেম্বরে। ইউরোপিয়ান কাপে বার্সেলোনা প্রতিপক্ষ হিসেবে পায় কাইজারলটার্নকে। প্রথম লেগে ৩-১ এ জয় পেলেও দ্বিতীয় লেগে প্রথমার্ধে ১-০ গোলে পিছিয়ে পড়েছিল ব্লগারনারা। হাফ টাইমে কোচের কাছ থেকে কথা শুনতে হবে ধরে নিয়েই খেলোয়াড়েরা ড্রেসিং রুমে গেলেন। ক্রুইফ এসে নিজের দুই হাত ঘষে বললেন, “ব্লাডি হেল! বাইরে তো জমে যাওয়ার মতো শীত।“ খেলা নিয়ে কোনো কথাই বলেননি তিনি। নিজের দলের উপর তার এই বিশ্বাসটুকু ছিল যে তারা খেলার মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারবে। হলোও তাই।
দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে আরেক গোল খেয়ে বসলেও ৮৯ মিনিটে হোসে মারি বাকেরোর গোলে এওয়ে গোলের এডভান্টেজে পরের রাউন্ডে চলে যায় ক্রুইফের দল। ফাইনালে সাম্পাদোরিয়ার বিপক্ষে অতিরিক্ত সময়ে রোনাল্ড কোম্যানের গোলে ক্রুইফের হাত ধরেই আসে কাতালুনিয়ার প্রথম ইউরোপিয়ান কাপ। এই দলটাই ছিল ক্রুইফের ‘ড্রিম টিম’।

১৯৯২ সালে মস্কোতে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ থেকে বাদ পড়ার পর থেকে ইয়োহান ক্রুইফ এর সাথে ক্লাব প্রেসিডেন্ট নুনেজের মনোমালিন্যের গুজব উঠে। এরপরও অনেকদিন ক্লাবের দায়িত্বে ছিলেন ক্রুইফ। ১৯৯০/৯১ থেকে ১৯৯২/৯৩ পর্যন্ত টানা তিনবার বার্সার হয়ে জিতেন লিগ শিরোপা। ১৯৯৩ সালে যেবার তৃতীয়বারের মতো লিগ শিরোপা জিতেছিলেন, সে মৌসুমে বার্সা লিগে গোল করেছিল ৮৭টি।
ধূমপানের কারণে হৃদযন্ত্রে সমস্যা দেখা দেয়ায় অপারেশন টেবিল থেকে ফেরার পর ক্রুইফ সিগারেটের বদলে মুখে সবসময় চুপাচুপস ললিপপ রাখতেন। ১৯৯৩/৯৪ মৌসুমের শেষ ম্যাচ পর্যন্ত দেপোর্তিভো লা করুনিয়া শিরোপা দৌড়ে এগিয়ে ছিল। সেই ম্যাচে দলটির সমর্থকরা ক্রুইফের ললিপপ খাওয়াকে ব্যাঙ্গ করে একটি ব্যানার বানিয়েছিল। কিন্তু ভাগ্যের লীলাখেলায় সেই ম্যাচে ভ্যালেন্সিয়ার সাথে পেনাল্টি মিস করে দেপোর্তিভো ডিফেন্ডার মিরাস্লোচ জুকিচ আর চতুর্থবারের মতো লিগ শিরোপা উঠে ক্রুইফের বার্সেলোনার হাতে।

চারদিন পর ছিল চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনাল। প্রতিপক্ষ এসি মিলান। একে তো টানা চতুর্থবারের মতো স্প্যানিশ লিগ জিতেছে, তার উপর ফেব্রুয়ারিতে জারাগোজার কাছে হারার পরের ৩০ ম্যাচে ২৮টিতেই জয়ের মুখ দেখেছে দলটি। আত্মবিশ্বাসে টগবগ করছিল ক্রুইফের দল, ক্রুইফ নিজেও। “বার্সা ফেভারিট,” ক্রুইফ বলেন, “মিলান পৃথিবীর বাইরের কেউ নয়। তারা তাদের ডিফেন্সের উপর নির্ভর করে খেলে, আমরা খেলি নিজেদের এটাকের উপর ভিত্তি করে।“ এসি মিলানের বিপক্ষে ক্রুইফ নামিয়েছিলেন কোম্যান, গার্দিওলা, রোমারিও, স্টয়চকভদের মতো বাঘা বাঘা বাঘা সব তারকাদের। সবাই নিজেদের সেরা ফর্মে। তিনজনের বেশী বিদেশী খেলতে না পারার নিয়মের কারণে মাঠে নামতে পারেননি লাউড্রপ।
এই অতি আত্মবিশ্বাসই কাল হয়ে দাঁড়াল ব্লগারানাদের জন্য। মিলানের কাছে ৪-০ গোলে হেরে ভঙ্গ হলো শিরোপাস্বপ্ন। বার্সার ডিফেন্স নিয়ে রীতিমতো ছেলেখেলা করেছে মালদিনির মিলান।

এক চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালের পর পাল্টে গেলো দৃশ্যপট। দলে অনেক পরিবর্তন আনলেন ক্রুইফ। অনেক তারকা খেলোয়াড়দের দল ছাড়তে হলো, তাদের পরিবর্তে আনা হলো ঘিওর্ঘি পপেস্কি, ঘিওর্ঘি হাঘিদের মতো খেলোয়াড়দের। কিন্তু কোনো কিছুতেই কিছু হচ্ছিল না। টানা দুই বছর শিরোপার দেখা না পাওয়ায় নুনেজের পুরনো রোষের শিকার হলেন ইয়োহান ক্রুইফ। সমর্থকরা তখনও তাদের প্রিয় কোচের পক্ষে। কিন্তু হলো না। নিজের শেষ ম্যাচে ক্যাম্প ন্যুতে তখন দাঁড়িয়ে সম্মান জানালো ডাচ এই কিংবদন্তিকে। দর্শকদের মাঝে ক্রুইফের জন্য জয়ধ্বনি, সাথে প্রেসিডেন্ট নুনেজের জন্য ধিক্কার। সমর্থকদের ভালবাসার মাঝে মাঠ ছাড়লেন ক্রুইফ।

বার্সেলোনার ডাগআউট ছেড়েছেন আজ থেকে ২৪ বছর আগে। কিন্তু বার্সেলোনাকে গড়ে দিয়ে গেছেন অসাধারণ এক ভিত্তি। তার গড়ে তোলা লা মাসিয়া থেকে উঠে এসেছে জাভি, ইনিয়েস্তা, মেসি, বুস্কেটসদের মতো খেলোয়াড়। তার গড়ে তোলা দলের হাত ধরেই স্পেন জাতীয় দল ২০০৮ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত রাজত্ব করেছে ফুটবল বিশ্বে। ক্রুইফের প্রবর্তন করা টোটাল ফুটবলের সূত্র ধরেই গার্দিওলা তৈরি করেছিলেন টিকিটাকা। যে খেলা দিয়ে গার্দিওলা বার্সেলোনায় নিজের ক্যারিয়ারে জিতেছেন সম্ভাব্য সব কয়টি ট্রফি। জিতেছেন ট্রেবল, এমনকি হেক্সাও। ক্রুইফের বপন করা বীজ লা মাসিয়ার খেলোয়াড়দের নিয়েই সফলতার মুখ দেখেছেন পেপ গার্দিওলা, লুইস এনরিকেরা।
বেশ ভালো প্রভাবই ফেলে গেছেন ইয়োহান ক্রুইফ। নাহলে আজও কেন বার্সেলোনার দায়িত্বে আসা সব কোচই নিজের খেলা সাজান ক্রুইফতত্ত্ব অনুসারে!
This is a Bangla Article about how Johan Cruyff changed Barcelona.
Reference:
-
How Johan Cruyff reinvented modern football at Barcelona
-
The 1988 Motín del Hesperia: can Barcelona now learn from it?
-
Barcelona v Milan revisited: The night in 1994 the Dream died